আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ


#

ঠিক বেড়াতে নয় একটা দরকারে গিয়েছিলাম ডেট্রয়েট। অখন্ড অবসর এবং অঢেল আপ্যায়ন সত্বেও মনটা খুঁতখুঁত করছিল, এতদূর এসে একটুও বেড়ানো হবে না! বিশেষত আকাশ যখন ঝকঝকে নীল, গরম নেই, শীত আসেনি, গাছের পাতা ঝরে পড়ার প্রস্তুতি হিসাবে রঙিন হওয়া শুরু করেছে, এমন মনোরম সময়ে গৃহবন্দি থাকাটা নিতান্তই শাস্তি।

" হেনরি ফোর্ড মিউজিয়াম ঘুরে আসি, চলো," বন্ধুবর দেবাংশুর প্রস্তাব। "সেটা কি?"

" গাড়ির মিউজিয়াম।" "হা কপাল, দেবাংশু একে ইঞ্জিনিয়ার, তার ওপর গাড়ির কোম্পানিতে আছে ২০ বছরের ওপর। তার শয়নে, স্বপনে গাড়ি থাকতে পারে, তা বলে গাড়ির মিউজিয়ামে বেড়াতে যাওয়া! কিন্তু আর কোথাও যখন যাওয়া হচ্ছে না, তাই যাই চলো। সাধারণভাবে কোন মিউজিয়ামে গেলে একটু পড়াশুনা করে যাওয়া আমার স্বভাব, কিন্তু এবার সেটা করিনি আর গিয়েই বুঝলাম কি ভুল করেছি।

 ডেট্রয়েটের ডিয়ার বর্ণে প্রায় ৫ লক্ষ ২৩ হাজার স্কোয়ার ফুট জুড়ে বিশাল মিউজিয়াম, যা তৈরি হয়েছিল ১৯২৯ সালে, হেনরি ফোর্ড এর উদ্যোগে। তিনি শুধু গাড়ির ব্যবসায়ী ছিলেন না, গাড়ির ইতিহাস রক্ষাতেও তাঁর ছিল বিপুল আগ্রহ, এই মিউজিয়াম তারই প্রমাণ।

গোটা মিউজিয়ামটিকে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন বিভাগে। ঢুকে প্রথমেই "প্রেসিডেনশিয়াল ভেহিকেল্স্"। এখানে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট দের ব্যবহৃত বিভিন্ন গাড়ি সাজানো রয়েছে। রয়েছে ১৯৬৩ সালের ২২ শে নভেম্বর জনএফ কেনেডি কে যে গাড়িতে গুলি করা হয়েছিল সেই গাড়িটি।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈভবের নীচে চাপা পড়ে থাকে তার সংগ্রামের ইতিহাস। এই গাড়ি তে চেপে আমরা যেন নিমেষে পৌঁছে গেলাম আমেরিকার সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্টের "সিভিল রাইটস অ্যাক্ট" আন্দোলনের দিনগুলিতে।

 প্রেসিডেন্ট রেগান ব্যবহৃত লিমুজিন টি যে কী অপরূপ। থিওডোর রুজভেল্ট ঘোড়ায় টানা যে গাড়িতে চড়েছিলেন সেটিও চোখ টানে। আবার যে গাড়ি চেপে যুবরাজ চার্লস সুন্দরী ডায়ানাকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, সেই গাড়িটি দেখেও বিশেষ আনন্দ পেলাম।

এরপর "দ‍্য গ্যালারি অফ জেনারেল মোটরস"। ফোর্ড যে গাড়িটি প্রথম বাজারে এনেছিলেন, সেখান থেকে শুরু করে আধুনিক মডেলের কত যে গাড়ি। 

 মিউজিয়ামের সবচেয়ে আলোচিত অংশটিতে গেলাম এর পরে। বিভাগের নাম, "উইথ লিবার্টি  অ্যান্ড জাস্টিস ফর অল"। একটা হলুদ রঙের বাস। ১৯৫৫ সালের পয়লা ডিসেম্বর এই বাসে এক কৃষ্ণাঙ্গী আমেরিকান, রোজা পার্কস্ তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী কোন শ্বেতাঙ্গ কে আসন ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। শুরু হয়েছিল সামাজিক অধিকারের লড়াই। বাসের সংলগ্ন দেয়ালে ছবি দিয়ে চমৎকারভাবে সমস্ত ইতিহাস লেখা। রোজা গ্রেপ্তার হওয়ায় শুরু হয় মন্টগোমারির বাস বয়কট আন্দোলন। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বাসে গাত্রবর্ণ নির্বিশেষে সকলের আসন পাওয়ার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। শুধু গাড়ি নয়, রয়েছে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের জন্য তৎকালীন দুটি কামরার রেপ্লিকা, একটি শ্বেতাঙ্গদের জন্য, শোভন এবং সুন্দর, কৃষ্ণাঙ্গদের কামরাটি মলিন। 

পরবর্তী বিভাগ, "হিরোজ্ অফ দ‍্য স্কাই"। সবচেয়ে দর্শনীয় লাগল ১৯০৩ সালে অরোভিল এবং উইলবার রাইট এর তৈরি বিমানটি। উত্তর মেরু অভিযানের প্লেনটি দেখেও আমি মোহিত। ছবি দিয়ে কাগজ ভাঁজ করে বাচ্চাদের প্লেন বানানো শেখানো হয়েছে। বাচ্চারা আনন্দের সঙ্গে কাগজের প্লেন বানিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আমার ছাত্রাবস্হার কথা মনে পড়ে গেল। 

 রেল রোড্স অংশে রয়েছে ট্রেনের ইতিহাস। বাষ্প চালিত ইঞ্জিন থেকে কত রকম ইঞ্জিন সাজানো। এরপর ফার্নিচার বিভাগ, যার অন্যতম আকর্ষণ একটি লাল রঙের রকিং চেয়ার।  ১৮৬৫ সালের ১৪ ই এপ্রিল  আব্রাহাম লিঙ্কন এই চেয়ারে বসে যখন থিয়েটার দেখছিলেন, তখন তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এখনো কি লেগে আছে রক্তের দাগ! 

রয়েছে বাকমিন্স্টার ফুলারের প্রস্তাবিত ডিমঅ্যক্সিয়ন হাউস, যেখানে  সর্বনিম্ন শক্তি খরচ করে সর্বোচ্চ কাজ করা সম্ভব বলে দাবি করা হয়েছে। 

পুরো মিউজিয়ামের প্রতিটি জিনিস ঘুরে দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, বিশেষ দর্শনীয় অংশগুলিই দেবাংশু ঘুরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু অন্য অংশগুলোও কম আকর্ষণীয় নয়। জায়গাটির গুরুত্ব প্রথমে না বোঝার জন‍্য নিজেকে ধিক্কার দিলাম। বেড়াতে ভালোবাসি, অথচ  গাড়ির চাকা না ঘুরলে এত বেড়ানো কোনদিনই সম্ভব হতো না। রথ ছাড়া পথ চলার আনন্দ পাওয়া যে অসম্ভব, তা বুঝতে যেতেই হবে হেনরি ফোর্ড মিউজিয়াম।