মাতা পুত্র সংবাদ


#

উদ্যানে ক্রীড়ারত দুই পুত্রদিগকে তাহাদের মাতৃদ্বয় মুগ্ধ নেত্রে অবলোকন করিতেছিল। মুমতাজ জিজাবাই কে বলিল, আশেপাশে কোনো পুরুষ নাই তো?

জিজাবাই আশ্চর্য হইয়া বলিল, কেন বলুন তো? সাম্রাজ্ঞী কি কোনো বিপদ আশংকা করিতেছেন?

আরে না, তুমি কি বুঝিবে! বোরখার ভিতর হইতে বাছা ঔরংজীব কে ভালোমতো দেখিতে পাইতেছি না, দাড়ি রাখিবার পর উহার মুখখানি কি যে সুন্দর হইয়াছে।

জিজাবাই মনে মনে বলিলেন, মন সুন্দর হওয়াটাই আসল. মুখে অবশ্য বলিলেন, সাম্রাজ্ঞী তো অনিন্দ্যসুন্দর, তাহার পুত্রের সুন্দর হওয়াটা স্বাভাবিক।

মুমতাজ খুশি হইয়া বলিলেন, শিবাজীর দাড়িটিও ভারী সুন্দর। উহার কি নিজেই যত্ন লয়? জিজাবাই স্বগতোক্তি করিলেন, মরণ, দাড়ি লইয়া আদিখ্যেতা দেখিলে গা জ্বলিয়া যায়। মুখে অবশ্য বলিলেন, হ্যা সাম্রাজ্ঞী, শিবা নামেই রাজা, থাকে গিরিকন্দরে, দাড়ির পিছনে নষ্ট করিবার মতো সময় উহার নাই। তাহার পর পুত্রের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া ভাবিলেন, মুমতাজ নেহাত বাজে কথা বলেন নাই, দাড়ি রাখিয়া শিবাকে বাস্তবিক সুন্দর লাগিতেছে। অতঃপর নিজেকে ধিক্কার জানাইয়া মহাদেবকে স্মরণ করিয়া বলিলেন, নজর না লাগিয়া যায়, বহু কষ্টে মুঘল মারাঠা  মৈত্রী স্থাপিত হইয়াছে, উহা যেন রক্ষা পায়। 

উদ্যানের অপর প্রান্ত হইতে অন্য একটি যুবক তাহার মাতার সহিত প্রবেশ করিলো, তাহার চক্ষু দুইটি বড়ো মায়াবী, কিঞ্চিৎ বিষণ্ণও বোধ হয়।  শিবাজী ও ঔরংজীবকে দেখিয়া সে মাতাকে প্রশ্ন করিল, আমি কি উহাদের সহিত ক্রীড়ায় যোগ দিতে পারি? ছেলেটির ভালো নাম যিসাস, ডাক নাম যীশু, মাতার নাম মেরি। মেরি বলিল, উহাদের সহিত তোমার ভালো লাগিবে না, তুমি উদ্যানের পূর্ব প্রান্তে দৃষ্টিপাত করো, ওই যে যুবকটিকে দেখিতেছ, পুস্তক ও কলম লইয়া বসিয়া আছে, তুমি উহার সহিত আলাপ কর। যীশু মাতার নির্দেশ পূর্বক পুস্তকধারী যুবকটির নিকট গিয়া স্বীয় পরিচয় দিলো।

যুবকটি সানন্দে তাহাকে আলিঙ্গন পূর্বক বলিল, আমার নাম রবীন্দ্রনাথ, মাতাঠাকুরানি আমায় রবি বলিয়া সম্বোধন করে, তুমিও তাই বলিও। অদূরে দাসী সমাভিব্যারে বসিয়া ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মাতা সারদা দেবী। যীশুকে দেখিয়া দাসীকে বলিলেন, এই নতুন ছেলেটির পাশে আমার রবিকে কি কালোই না  লাগিতেছে, আগামীকল্য হইতে উহার জন্য হলুদ দিয়া সর বাটিবি, আর উহার দাড়িখানি দেখো, মুখখানিকে যেন আরো সুন্দর  করিয়াছে, রবিকে দাড়ির জন্য বেশি বয়স্ক লাগে, কাহাকে বলিব এই সব দুঃখের কথা!

ওদিকে যীশু মেরি কে আসিয়া বলিল, রবি কিন্তু অনন্য প্রতিভার অধিকারী, আমার গল্প শুনিয়া কেমন চমৎকার গান বাঁধিয়াছে, তাহাতে আবার সুর ও দিয়াছে, তুমি শুনিবে?

মেরি উত্তর দিবার পূর্বে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ভারিক্কি চেহারার অন্য একটি যুবক। তাহার বর্ণ গৌর, প্রায় সম্পূর্ণ মুখাবয়ব দাড়িতে ঢাকা, শুধু দুইটি উজ্জ্বল চক্ষু দৃশ্যমান। তাহার পশ্চাতে যে ভদ্রমহিলা আসিতেছিলেন, তাহাকে দেখিয়াই বোঝা যায় তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের রমণী, সম্ভবত ভারিক্কি যুবকটির  মাতা, কিন্তু ছেলের সহিত খুব একটা সখ্যতা নাই।

যুবকটি আসিয়া হাঁকডাক শুরু করিল, বন্ধুগণ, সবাই একত্র হও, আমার কিছু বলিবার আছে। সারদা দেবী দাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এ আবার কে? এই গৌরবর্ণ প্রাপ্ত হওয়া সর হলুদের কর্ম নহে। সম্ভ্রান্ত রমণীটি বললেন, ও আমার ছেলে, কার্ল মার্কস, আমি হেনরিয়েটা প্রেসবার্গ।

মার্কস ততক্ষনে বলিতে শুরু করিয়াছে বন্ধুগণ, ইহা অত্যন্ত লজ্জার বিষয় যে দেশের এই দুর্দিনে আপনারা গান, ক্রীড়া এইসব বালখিল্য বিষয় লইয়া মত্ত আছেন। সকলের বিস্ময় বিমূঢ় মুখ দেখিয়া তিনি আরো বলিলেন, নুতন নিয়ম হইয়াছে শহরের উদ্যানে প্রবেশ করিতে হইলে দাড়ি কাটিতে হইবে। আপনারা কি এই ঘৃণ্য প্রস্তাবে রাজি আছেন?

সকলে সমস্বরে বলিল, কদাপি নহে।

তাহা হইলে কি করণীয় সমীচীন বলিয়া বোধ হয়? 

এই কথায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হইলো, কেহ কাহারো সহিত সহমত হইলো না।  মাতা গণ কত বুঝাইলেন দাড়ি কাটিলে ক্ষতি কি? উহা আবার বৃদ্ধি পাইবে,কিন্তু পুত্র গণ সেই উপদেশে কর্ণপাত করিলেন না।

ইতোমধ্যে সবার অলক্ষ্যে উদ্যানে আসিয়াছেন আর একটি সুদর্শন যুবক। তাহাকে দেখিয়া মার্কস উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিলেন, আরে, তুমি কখন আসিলে? অতঃপর সবার সঙ্গে যুবকটির পরিচয় করাইয়া বলিলেন, ইহার নাম, চার্লস ডারউইন। চার্লস সবাইকে নমস্কার করিয়া জানাইলেন, তিনি মাতা সুসান কে সঙ্গে লইয়া একটি প্রস্তাব দিতে আসিয়াছেন।  তাহার কাছে বিউগল নামক একটি জাহাজ আছে, তাহাতে করিয়া দেশের সকল  যুবক, যাহারা দাড়ি কাটিতে অনিচ্ছুক, সাগর ভ্রমণে যাইতে পারেন। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হইলে ফিরিয়া আসিবেন।

এই প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথ সর্বাপেক্ষা খুশি হইয়া বলিলেন, আমার ছোটবেলায় লেখা কবিতা এইভাবে সত্য হইবে, তাহা কখনো ভাবি নাই। ভাই চার্লস, তুমি আমার মধু মাঝি। সারদা দেবী স্থান কাল ভুলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন, পড়াশুনা তো কবেই বিসর্জন দিয়াছ, এখন ঘরবাড়িও বিসর্জনের ধান্দা করিতেছ, বলিতেছি তোমার বাবামশাইকে। রবীন্দ্রনাথ মাতার এই মূর্তি দেখিয়া অবাক হইয়া ডাকিলেন, মা-----

 

বুবকা ধাক্কা দিয়ে বললো, মা, আর কত ঘুমাবে? ওঠো, দেখো দাড়ি কেটে এসেছি, শান্তি হয়েছে? আহা, কতদিন বাদে ছেলের পরিচিত মুখ দেখলাম।

বললাম, দ্যাখ তো কত সুন্দর লাগছে!

দাড়াও না, আমেরিকা ফিরে আবার দাড়ি রাখবো, সেখানে তো তুমি ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্ত করতে পারবে না।

মনে মনে বললাম, রাখিস, আমি আবার একটা অভিনব স্বপ্ন দেখব।