কর্মসূত্রে গত সাত বছর দিল্লি যাতায়াতের সুবাদে আমি দিল্লির একটি মহিলা দঙ্গলের সদস্য| সেখানে সকলেই কর্মরতা, উচ্চশিক্ষিতা, উচ্চপদস্থা| দঙ্গলটিতে প্রধানত কাজকর্ম আর কর্মস্থল-সম্বন্ধীয় আলোচনা হলেও, মাঝে মধ্যে অন্যান্য আলোচনাও হয়| যেমন গত মে-জুন মাসে, যখন কোভিডের চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি চলছে, দিল্লিতে অক্সিজেনের হাহাকার, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, তখন শুধুমাত্র হাসপাতালের শয্যা আর ভেন্টিলেশন আর ICU আর অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর সম্বন্ধীয় তথ্যই সেখানে থাকত| সে তো এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন| সেই সময়ে দঙ্গলের একজন সদস্য এবং আরো দুজন সদস্যের স্বামী চলেও গেলেন| তাঁরা কেমন ভাবে ছেলেমেয়েদের নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, তার কিছু আভাস এখানেই পাই|
কয়েকদিন আগে একজন সদস্য লিখলেন, “What does freedom mean to you ...... in 10 words.” তার উত্তরে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন মতামত জানালেন| একজন বললেন, “Ability to run my life in my own terms.”; আর একজন উত্তর দিলেন, “Being myself in every respect, ability to create my cocoon to pause”; কেউ বললেন “Freedom of thought and expression is important”: একজনের মতে “Freedom is taking on only those responsibilities I want to take”; কারোর মতে “Freedom is expressing myself without fear on any platform” অথবা, “To be, to do, to express my authentic self at all times”|
১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষের স্বাধীনতার উদ্যাপন যেমন প্রতিবছর হয়, তেমনই হবে| যদিও ২০২০ আর ২০২১-এ সারা পৃথিবীর কোনো স্বাভাবিক যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই হয়ত মনে করবেন না যে তিনি সম্পূর্ণ নিজের মতে চলতে সক্ষম, run my life in my own terms! এমনকি দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম – যিনি গড়ে বছরে বারো মাসে আঠারোখানি বিদেশ ভ্রমণে অভ্যস্ত – তিনিও প্রধানত রাজধানীতেই আটকে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন! কিন্তু এই দুই বছরের কথা যদি বাদও দিই, ১৯৪৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আমরা, শিক্ষিত, শহুরে, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত মহিলারা কি নিজেদের যথেষ্ট স্বাধীন বলে মনে করতে পারতাম?
স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ে ভাবতাম মেয়েদের স্বাধীনতা নির্ভর করে তাদের উপার্জন ক্ষমতার ওপরে| চাকরি করলেই স্বাধীনতা, না হলে নয়| তখন বুঝতে পারতাম না, উপার্জন করলেই নিজের মতে খরচ করার স্বাধীনতা তো আসে না|
আমার ঠাকুরমা আর দিদিমা দুজনে জন্মেছিলেন অবশ্যই পরাধীন ভারতবর্ষে| ঠাকুরমা খুবই সামান্য পড়াশোনা করেছিলেন – হয়ত বাড়িতে, হয়ত দু-এক বছর কোনো প্রাইমারি স্কুলে| বাংলা পড়তে পারতেন, লিখতেও পারতেন, ইংরেজি জানতেন না| স্বাধীন জীব তিনি কোনোদিনও ছিলেন না| আমার দিদিমা পড়াশোনা করেছেন রেঙ্গুনে, ঢাকায়, ধুবড়িতে আর বরিশালে – স্কুল, স্কুলের পরে কলেজেও| এমনকি চাকরিও করেছিলেন কিছুদিন, পটুয়াখালিতে মেয়েদের স্কুলে, সম্ভবত ১৯৪০-৪১ সালে| তিনি কি নিজেকে তখন স্বাধীন মনে করতেন? একদমই না, কারণ আজকে মেয়েদের স্বাধীনতা বলতে যা বুঝি, তিনি তো সেভাবে ভাবতেই শেখেননি কখনো| Freedom of thought and expression – হয়ত তাঁরা ভাবতেন স্বাধীনতা শুধু দেশেরই হয়, ব্যক্তিমানুষের আবার স্বাধীনতা কি?
আমার মা’র প্রজন্মের কথা যদি ভাবি – তাঁদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার রূপ কি ছিল? এঁরা জন্মেছেন মোটামুটি ১৯৩০-এর দশকে| তখনও কিন্তু শহুরে ভদ্র পরিবারের মেয়েরা সবাই স্কুলে পড়ার স্বাধীনতা পেতেন না| আমার বাবার পরিবারের বেশির ভাগ মেয়েরা, আমার পিসিমারাই, তা পাননি| আমার ঠাকুরমার অনেকগুলি ভাই, সে সময়ের নিয়মমাফিক তাঁদের মধ্যে ছোটরা আমার পিসিমাদের চেয়ে সামান্যই বড়| তাঁরা অনেকেই লেখাপড়ায় খুব ভাল, এমনকি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্থানাধিকারী| সেকালের পরীক্ষায় তো প্রথম দশটি স্থানে ৭২জন গুঁতোগুঁতি করত না, ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করার একটা মূল্য ছিল| অথচ তাঁদেরই কনিষ্ঠা ভগিনী অল্পদিন স্কুলে যাবার পরই বাড়িতে বন্দী হলেন, বিয়ের উদ্যোগের কারণে| যদিও তাঁর বিয়ে হতে হতে অনেকগুলি বছরই গড়িয়ে গিয়েছিল|
মেয়েদের স্বাধীনতার সঙ্গে লেখাপড়ার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয়| তা কিন্তু একেবারেই ডিগ্রী পাওয়ার লেখাপড়া নয় – ওটা গায়ের গয়না| উচ্চশিক্ষিত, চাকরিরত, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মহিলাকেও আমি “লোকে কি বলবে?” – এই ভয়ে কাতর থাকতে দেখেছি| আবার উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির উচ্চমাধ্যমিক পাশ, অল্পবয়সে বিবাহসূত্রে বিদেশে বসবাসকারী মেয়েকে দেখেছি বিবাহবিচ্ছেদের পরে সীমিত আর্থিক ক্ষমতা সত্বেও অসীম ধৈর্য আর পরিশ্রমের জোরে ঐ বিদেশেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে| তার ইন্ধন সংগ্রহ হয়েছিল education loan নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির মাধ্যমে| সন্তান নিয়ে অনির্দিষ্ট পথে পা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল স্বাধীনতার সঙ্গে যে মর্যাদাবোধ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তার দায়ে|
অঙ্কে necessary condition আর sufficient condition বলে দুটো আলাদা ব্যাপার আছে| Necessary condition আসে প্রথমে – ঐ শর্ত পূর্ণ না হলে পরের ধাপে যাওয়াই যায় না| আবার ঐ শর্ত পূর্ণ হলে যে পরের ধাপে যাওয়া যাবেই – তা নাও হতে পারে| তখন দরকার হয় sufficient condition| মেয়েদের ক্ষেত্রে লেখাপড়া হল necessary condition| কিঞ্চিৎ বিদ্যে পেটে না ঢুকলে স্বাধীনতার মর্ম কি বোঝা যায়? অথচ এটা যে sufficient condition কোনোমতেই নয়, তার উদাহরণ ভুরি ভুরি|
আশুতোষ চৌধুরী, প্রমথ চৌধুরীদের পরিবার সেকালের কলকাতার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত পরিবার| কি বিদ্যায়, কি যশে, কি আভিজাত্যে এই পরিবারের জোড়া মেলা ভার| সেই বাড়ির মেয়ে হলেন প্রসন্নময়ী দেবী – সুশিক্ষিতা, কবি, ব্যক্তিত্বসম্পন্না| তাঁর একটি আত্মজীবনী রয়েছে, নাম পূর্বকথা| সেখানে এক চিকিৎসক প্রতিবেশী সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন: অল্পবয়সে পত্নীবিয়োগ হওয়া সত্বেও তিনি যে আর বিবাহ করেন নাই – এতে তাঁর মহত্বই প্রকাশ পায়| প্রসন্নময়ী নিজে তাঁর শ্বশুরবাড়ি পাবনায় বিশেষ বসবাস করেননি, কন্যাকে নিয়ে ভাইদের সঙ্গেই থাকতেন| প্রসন্নময়ীর মত একজন নাগরিকার পক্ষে এই মন্তব্য খুবই অদ্ভুত নয় কি? স্বাধীনতাকে যদি আমরা নিজস্ব মতামত প্রকাশের ক্ষমতা বলে ভাবি, যদি ভাবি স্বাধীনতা আমাকে দৃষ্টির স্বচ্ছতা দেবে, তাহলে প্রসন্নময়ীর স্বাধীনতাকে আমরা কিভাবে দেখব? মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা হয়ত তাঁর ছিল, কিন্তু দৃষ্টির স্বচ্ছতা ছিল কি? তা যদি না থাকে, তাহলে যে মত তিনি প্রকাশ করেছেন, সে তো অন্য কারোর মত| স্বাধীনতা যদি আমাকে চিন্তা করতে না শেখায়, যদি গড্ডলিকার মত চোখ বুজে একজনকেই অনুসরণ করে চলি, যদি সামাজিক মাধ্যমের নিতান্ত অসম্ভব রকমের বক্তব্য অনবরত এক দঙ্গল থেকে অন্য দঙ্গলে চালাচালি করতেই থাকি আর কেউ তার যথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করলে বলতে থাকি “ও তো আমি শুধু পাঠিয়েছি, লিখিনি তো” – অর্থাৎ দায়িত্ব তো আমার নয় – তাহলে কি আমি নিজেকে স্বাধীন বলতে পারি?
দায়িত্ব নেওয়ার স্বাধীনতা বড়ই কঠিন| নিজের মত প্রকাশ করতে হলে, মতামতের দায়িত্ব নিতে হয়| রাজনৈতিক জীবনেই হোক, বা ঘরের কোনে ব্যক্তিগত জীবনেই হোক, অপরের কথা শুনে চলে বিপদে পড়লে, তার ওপরে রাগারাগি করা সহজ| নিজের মতে চলে বিপদে পড়লে, কিল খেয়ে কিল চুরি ছাড়া আর কিছু করার থাকে না!
আমার কখনো সখনো মনে হয়, আমাদের ভারতবাসীদের মধ্যে ভক্তিবাদ এত প্রবল, যে আমরা দায়িত্ব নেবার ক্ষমতাই হয়ত হারিয়ে ফেলেছি| বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, বিশ্বাস করে যাও; পেলে তো ভালো, না পেলে অন্তত মানসিক শান্তি তো বজায় রইল – ভগবান দিলেন না, ভাগ্যে নেই, কি আর হবে? ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়, “বড়রা তোমার চেয়ে বেশী জানেন, কেননা তাঁরা বড়; তাঁদের কথা অমান্য করতে নেই”| আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতীকে মনে আছে নিশ্চয়? তার স্বামী নবকুমারের হয়েছিল নিউমোনিয়া| যখন বৈদ্য মাথা নেড়ে চলে গেলেন, নবকুমারের মা-বাবা আর পাড়াপড়শীরা হাত-পা আছাড়ি-বিছাড়ি করে কাঁদতে বসেছিল, কিন্তু আরো ভালো ডাক্তার ডেকে আনার কথা ভাবেনি| “আয়ু থাকলে বাঁচবে”! সত্যবতীর সেই জোর ছিল যার সহায়তায় শ্বশুর-শাশুড়ির মত উপেক্ষা করে সাহেব ডাক্তার ডাকিয়ে এনে তার স্বামীকে বাঁচাতে পেরেছিল| সত্যবতীকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার, নিজের যুক্তি অনুযায়ী বিচার করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তার বাবা রামকালী কবিরাজ| কিন্তু রামকালী আর সত্যবতী, শুধু সাহিত্যজগতে নয়, রক্তমাংসের শরীরেও হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র| যুক্তিবাদের বিশেষ কোনো স্থান আমাদের মধ্যে এখনও নেই| ব্যক্তিগত জীবনেও নেই, রাজনৈতিক বা সামাজিক জীবনেও নেই| কত মহিলাকে যে আলোচনার সময়ে বলতে শুনেছি, “আমার উনি বলেছেন যে .......”! ব্যস, বেদবাক্য|
আজকেই কোন একটা বিজ্ঞাপনে পড়ছিলাম, “স্বাধীনতা কথাটা কানে আসলেই মনে হয় মাথার ওপরের আকাশটা যেন আরো আরো বড় হয়ে গেল”| তা হতে পারে| কিন্তু আকাশটা তো আছেই, আমি আকাশের তলায় রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মাঝে থাকব, নাকি অন্যের বানানো একটা কংক্রিটের ঘরে বেশি আরাম বোধ করব, সে সিদ্ধান্ত আমার| না, হয়ত এটা পুরোপুরি ঠিক বলা হল না| আমাকে তো বুঝতে হবে যে কংক্রিটের ঘরের ছাদে নীল রং থাকলেও সেটা আকাশ নয়, ঘরের দেওয়ালে সবুজ লতা-পাতা আঁকা থাকলেও সেটা মুক্ত প্রকৃতি নয়| যে মেয়ের পা থেকে কখনো লোহার জুতোটা খোলা হয়নি, সে কেমন করে জানবে যে পায়ে জুতো না থাকাটাও সম্ভব?
কিন্তু যারা জানে যে কংক্রিটটা রঙিন হলেও, সেটা কংক্রিটই? আমার এক পরিচিতার বাবা, তার বিয়ে দেওয়ার সময়ে বলেছিলেন, “আমার মেয়ে এখন চাকরি করে বটে, তবে এমন বিয়ে দিচ্ছি যে আর চাকরি করতে হবে না, আরামেই থাকবে”! সেই মহিলাকেও কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিতে হল বলে কোনোদিন বিশেষ আপশোষ করতে দেখিনি| উচ্চপদস্থ স্বামীর কল্যাণে শাড়ি-গয়নার মোড়কে সারা জীবন তিনি ভালই কাটিয়েছেন| কে যেন বলেছিলেন না, “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়?” আমার তো মনে হয় অনেকেই, কারণ স্বাধীনতার মূল্যটা বড্ড বেশি| আর অনেক সময়েই সে মূল্যর বেশিটাই নিজের কাছে – আমি আমার মতো, আর কারুর মতো হব না, তাতে আমার যা হয় হোক, আমার দায়িত্ব একা আমারই, আর কারো নয় – এ কথা বলা সহজ নয়|
Comments