বেড়ানোর ডায়েরি: ২


#

         ছোটবেলা থেকেই বেড়ানোর নামে আমি এক পায়ে খাড়া| কোভিড়ের সময়ে আমার সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল এইটাই| এমনকি শান্তিনিকেতনেও যাবার উপায় নেই| শেষে দু-ঘন্টা দূরে টাকি গিয়ে মনে হল, আহা কি মুক্তি! হঠাৎ হঠাৎ আমার এরকম বেড়ানোর বাতিক চাপে| যেতেই হবে| সঙ্গে কেউ গেল তো ভাল, না গেল তো আমি একাই যাব| সে আঁটপুরই হোক, বা প্যারিস|

আমার ঠাকুরমা বলতেন, পায়ের তলায় সর্ষে| আমেরিকায় থাকার সময়ে পায়ের তলায় চাকা আর দিগন্ত-বিস্তৃত রাস্তা থাকায় ঝট করে বেরিয়ে পড়ায় অসুবিধে ছিল না| বিশেষ করে ছাত্রাবস্থায়| পেন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমাদের একটা ঘনিষ্ঠ বাঙালী বন্ধুগোষ্ঠী ছিল| শুক্রবার রাতে কারোর বাড়িতে রাতে খাওয়া এবং মধ্যরাত কাটিয়ে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার| তাদের মধ্যে একজন চাকরি নিয়ে চলে গেল ক্লীভল্যান্ডে, পেন স্টেট থেকে সাড়ে চার ঘন্টার ড্রাইভ| এক শুক্রবার আমরা বাকিরা আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময়ে জয়ন্তর ফোন,

“তোরা কি করছিস এখন? কবে এখানে আসছিস? আমাদের ফ্ল্যাটটা মন্দ নয়”|

তক্ষুণি পিকলুর জবাব, “ফ্ল্যাট পেয়ে গেছিস তোরা? দাঁড়া আমরা আসছি”|

এক ঘন্টার মধ্যে গাড়িতে আমরা জনা পাঁচেক রওনা হয়ে পড়লাম| রাত একটার মধ্যেই মনে হয় পৌঁছে গিয়েছিলাম|

         এই যে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে পড়ার আরাম, নিয়মমাফিক গাড়ি চালানোর নিশ্চিন্ততা – এটা এদেশে না থাকায় আমার মত লোকের বড্ড অসুবিধে হয়| অবশ্য ইউরোপেও কখনো গাড়ি চালিয়ে বেড়াইনি আমরা| দরকার হয় না| ইউরোপের শহরগুলো তো পুরনো, তাই দেখার অংশটা ছোট| তাছাড়া সেখানে মেট্রো বা সর্বজনীন যানবাহনের ব্যবস্থা সাধারণত খুবই ভালো| তা বলে সর্বত্র যে নিরাপদ তা মোটেও না|

         মাদ্রিদে অয়নের এক সহকর্মী আছেন| কোভিডের আগে পর্যন্ত অয়ন আট-দশবার তাঁর ডাকে মাদ্রিদে গেছে সাত থেকে দশ দিনের জন্য| বার কতক আমি সঙ্গে গেছি| অয়ন আর লিয়ান্দ্রো যখন ঝপাঝপ পেপার লিখছে, আমি ট্যাং ট্যাং করে বাসে-ট্রামে চেপে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি| ওদের সভ্য-ভদ্র দেশ, আমাদের মত বাদুড়-ঝোলা ভিড়ও হয় না, ওঠার সময় বা নামার সময় অকারণ ঠ্যালাঠেলিও হয় না| কিন্তু সেদিন দেখি ট্রাম থেকে নামার সময় একটু গুঁতোগুঁতি হচ্ছে আর আমার ব্যাগটা কেন যেন একজনের কোটের মধ্যে বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে| তার চেহারাটা খ্যাঁচা মার্কা, গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি| অগত্যা কলকাতার টেকনিক প্রয়োগ করতে হল| ব্যাগটা গায়ের জোরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে নেমে গেলাম| কোটটাও টেনে নিতে আপত্তি ছিল না| কোটের মালিকও দেখি নামল, কোটটা সামলে নিয়ে গটগট করে একদিকে হাঁটা লাগাল| আর আমি দেখি আমার পার্সের ফ্ল্যাপটা খোলা| ভেতরের চেনটা অবশ্য টানাই আছে| টাকাপয়সা তো বটেই, পার্সে পাসপোর্টও ছিল| বিদেশ-বিভূঁই বলে কথা, পাসপোর্টই আমার একমাত্র পরিচয়! তার পর থেকে অবশ্য পাসপোর্ট হোটেলেই রেখে বেরই, জেরক্স করা কাগজ সঙ্গে থাকে|

         ঠিক এই ঘটনারই repeat performance হল মিলানে| মিলান রেলওয়ে স্টেশনটা খুব বড়| লোকাল ট্রেন, দূরপাল্লার ট্রেন, বাস সব ওখান থেকেই ছাড়ে| একদিন সকালে অয়ন আর আমি ম্যাপ খুলে জরিপ করছি কিভাবে সারাদিনের প্ল্যান করব, কত দামের টিকিট কাটব ইত্যাদি| স্টেশনে তো অনেক ধরনের লোকজনই ঘোরাঘুরি করে| দেখছি এক দঙ্গল বিভিন্ন বয়সের মহিলা, পোষাক-পরিচ্ছদ তেমন সুবিধের নয়, আশেপাশেই রয়েছে| অয়ন যখন টিকিট মেশিনে টিকিট কাটতে গেল, একজন এসে বোধহয় বলার চেষ্টা করেছিল যে ‘আমাকে বল কোথায় যাবে, টাকা দাও, আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি’| তা অয়ন কিছু বলার আগেই দেখলাম পুলিশ এসে তাকে ভাগিয়ে দিল| আমরা হিসেব করে টিকিট কেটে ট্রামে উঠলাম| সেই মহিলাদের দলটাও উঠল|

         আবার সেই মাদ্রিদের মত অভিজ্ঞতা| আবার আমার আড়াআড়ি ভাবে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ এক মহিলার কোটের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে লাগল| যেই সে মহিলা হাত বাড়িয়েছে আমার পার্সের দিকে, আমি মহিলার কব্জিতে বেশ জোরেই একটা চড় কসিয়ে দিয়েছি| এইটা বোধহয় মহিলার হিসেবে ছিল না| এক মুহূর্ত চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকাল| আমিও কটমট করে তাকালাম| তখনই তারা সবাই মিলে হুড়মুড় করে ট্রাম থেকে নেমে পড়ল|

         গণপরিবহনে আরো কতরকম অভিজ্ঞতা| ব্রিসবেন থেকে গোল্ড কোস্টে গেছি সারাদিনের জন্যে| সকালে বাস ধরে গেছি, সন্ধেবেলা শেষ বাস ধরে ফিরব| মহানন্দে সমুদ্রে স্নান হল, ওপাল কেনা হল, আরো যা যা করার সব করা হল| যথেষ্ট সময় হাতে নিয়েই বাস স্টপে এসে দাঁড়ালাম, সকালে রাস্তার যে দিকে নেমেছি তার উল্টো দিকে| একটু অপেক্ষা করার পর দেখলাম উল্টোদিক দিয়ে একটা বাস চলে গেল| তার পর দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি, কোথায় বাস? রাত হয়ে গেল, একটু চিন্তা হচ্ছে| অনেকক্ষণ পরে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে, ঐ বাসটাই ছিল আমাদের ফেরার বাস! ওখানটা একটা লুপের মত, দুদিকের বাসই একই পথে ঘোরে!! এবার কি হবে? সারারাত গোল্ড কোস্টের বাস স্টপে? এটা ১৯৯৮ সালের কথা| মোবাইলের যুগ নয়| একটা ফোন বুথ খুঁজে বার করে ব্রিসবেনের বন্ধুকে ফোন করা হল| সে বলল ‘তোমরা ট্রেন ধর, অনেক রাত অবধি ট্রেন পাওয়া যায়| আমি স্টেশন থেকে তোমাদের হোটেলে পৌঁছে দেব’|

         জার্মানীতে প্রথমবার গেছি যখন শঙ্করী বেশ ছোট| আমরা আছি বিলেফেল্ড বলে একটা ছোট বিশ্ববিদ্যালয়-শহরে| ওখানেই অয়নের কনফারেন্স| তার মধ্যে একদিন সময় করে নিয়ে আমরা যাব কোলনে, ক্যাথিড্রাল দেখতে| ট্রেনে যাব, কারণ ক্যাথিড্রালটা একেবারেই স্টেশনের পাশে| একটা লম্বা ট্রেনের ফাঁকা একটা কামরা দেখে উঠলাম তিনজনে, আরাম করে বসেও পড়লাম| ট্রেনে কি সব যেন অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে, আমরা অতটা কান দিইনি| বার বার কোলন নামটা কানে আসছিল, আর চিন্তা করার কি আছে?

         ও মা, খানিক পরে টিকিট চেকার এসে বলে কি, ‘তোমরা তো ভুল ট্রেনে উঠেছ’|

তার মানে, এই যে বলছে এ ট্রেনটা কোলন যাবে?

‘এটা কোলন যাবে না, যাবে কোলন ফ্লুগহাফেন, অর্থাৎ কোলন এয়ারপোর্ট’|

কি করে তা সম্ভব? আমরা বিলেফেল্ড থেকে ঠিক ট্রেনেই উঠেছি, স্টেশনে দেখাচ্ছিল Destination: Koln|

‘এই একই ট্রেন মাঝখানে দুভাগ হয়ে গেছে| সামনের অংশটা চলে গেছে কোলনের দিকে| তোমরা পেছনের যে অংশটায় আছ, সেটা যাবে এয়ারপোর্ট’|

তাহলে এখন উপায়?

‘তোমরা একটা কাজ কর| পরের স্টেশন ডর্টমুন্ড, ওখানে নেমে যাও| ওখান থেকে কোলনের ট্রেন পেয়ে যাবে| এই টিকিটেই হবে, নতুন টিকিট কিনতে হবে না|’

         এই ট্রেন ভাগ হওয়া আর ছোট ট্রেন – বড় ট্রেনের চক্করে আরো পড়তে হয়েছে| প্রথমবার প্যারিস গেছি, সেখান থেকে গেছি ভার্সাই| যাবার সময় বেশ লম্বা একটা দেড়তলা ট্রেনে চেপে গেছি| ফেরার সময় লম্বা প্ল্যাটফর্মের শেষের দিকে দাঁড়িয়েছি, ভিড়ের থেকে একটু দূরে| ট্রেন এসে হুস করে আমাদের পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওই মাথায় গিয়ে দাঁড়াল – বোধহয় দুটো কি তিনটে কামরা| তখন ছোট্ট শঙ্করীকে বগলদাবা করে ছোট ছোট!

         এর উল্টোটাও হয়েছে| প্যারিস থেকে ফন্টেনব্লু (Fontainebleau) গেছি| যাওয়াটা সবসময়েই সহজ. স্টেশনে যাও, টিকিট কাট, ঠিক স্টেশনে নামো, অনেকেই নামে, সুতরাং বিশেষ অসুবিধে নেই| বাস ধর| অনেকেই তোমার সঙ্গে একই বাস ধরবে| তারপর হুড়মুড় করে সবাই একই জায়গায় নামবে| সমস্যা হল ফেরার সময়| ফরাসী ভাষা না জানলে কোন বাস কোথা থেকে ধরতে হবে তা নিয়ে কিঞ্চিৎ সমস্যা থেকেই যায়| যেমন আমি একটা বাসে উঠে পড়ে সামনে বসা একটি অল্পবয়সী ছেলেকে শুধালাম,

“এই বাসটা কি ফন্টেনব্লু রেল স্টেশনে যাবে? আমি প্যারিস ফেরার ট্রেন ধরব|”

ছেলেটি একটু ভেবে বলল, “যাবে| কিন্তু তোমাকে নামাবে উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে| একটু এগিয়ে, একটা underpass দিয়ে তোমাকে ঠিক প্ল্যাটফর্মে উঠে আসতে হবে”|

আমি তাই করলাম| প্যারিসমুখী প্ল্যাটফর্মে এসে বসেছি, সেই ছেলেটি দেখি দৌড়ে আসছে| বলল, “বাসটা এখানে দু-মিনিট থামে| দেখে গেলাম তুমি ঠিক মত আসতে পেরেছ কি না”|

         দেশী গণপরিবহনের একটা অভিজ্ঞতা বলে এবারের পালা শেষ করি| ১৯৮০-৮১ সাল নাগাদ কুলু-মানালী যাচ্ছি, মা, বাবা আর আমি| চন্ডীগড় থেকে কুলুর বাসে চড়েছি, আজকের ভাষায় cattle class, অর্থাৎ সাধারণ লোকজন যে বাসে যাতায়াত করে সেই বাস, কোনো ফ্যান্সি ট্যুরিস্ট বাস নয়| সুন্দরনগর বা ওই রকম নামের কোনো একটা জায়গায় এসে জানা গেল পথ অবরোধ, বাস যাবে না| সে কি কথা? তাহলে আমরা কি করব? কোথায় যাব? কোথায় থাকব?

কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর?

হিমাদ্রি কহিল, মোর চির-নিরুত্তর|

তা হিমাদ্রি কি আর আমাদের জন্য তার চির-নিরুত্তর ভাঙবে? আমরা বাসেই বসে আছি| দুপুর গড়িয়ে বিকেল| সন্ধের মুখে হঠাৎ শোনা গেল অবরোধ উঠে গেছে| বাসের যাত্রীরা সবাই প্রায় স্থানীয় পাহাড়ী লোক| তারা এই সময়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিল| অবরোধ উঠে গেছে খবর পেয়ে নিজেরাও এসে হাজির হল, বাসের ড্রাইভারকেও পাকড়ে নিয়ে এলো| তার অবস্থা তখন সঙ্গীন| দাঁড়াতে পারছে না, পা টলছে| আমি বাসের জানলা দিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছি| তার বোধহয় সে রাতে যাবার ইচ্ছে ছিল না, সবাই খানিকটা জোর করেই তুলে দিল বাসে| তার পরের বর্ণনা মুজতবা আলি সাহেব আমার চেয়ে অনেক ভালো দিয়ে গেছেন| আফগানিস্থানের খতরনাক রাস্তায় বাস মোড় নেবার সময় আলি সাহেব দেখেন যে বাসের চারটে চাকার একটা প্রায়শই শূন্যে থাকছে| দেখে তিনি বাসের চালককে বলেছিলেন,

“আপনি কি করে এমনভাবে বাস চালাচ্ছেন? মোড় নেবার সময় আমি তো ভয়েতে চোখ বুজে ফেলছি”|

চালক বললেন, “আম্মো”!

আমাদের চালক সাহেবের এ সমস্যা হয়নি, কারণ সম্ভবত চোখ খোলা রাখাই তাঁর পক্ষে কঠিন হচ্ছিল|

         আমি আর বাবা বসেছিলাম পেছনে, সামনের সীটে মা| তার সামনের সীটে দুজন আলু ব্যবসায়ী| তাঁরা কুলু বা কাছাকাছি অন্য কোনো জায়গা থেকে আলু কিনতে যাচ্ছেন| মা সারা পথ তাঁদের সঙ্গে আলু ব্যবসায় সংক্রান্ত এত গপ্পো-গাছা করছিল যে আমার মনে হচ্ছিল মা না এবার বেথুন কলেজের চাকরি ছেড়ে আলু ব্যবসায়েই নেমে পড়ে! বাসের চালকের রকম দেখে এক এক করে প্রায় সমস্ত যাত্রী নেমে গেল| কুলুতে পৌঁছতে রইলাম আমরা তিনজন আর ওনারা দুজন| সারা পথ দেখলাম মা একেবারে পিঠ সোজা করে বসে রইল, যাকে বলে ramrod stiff| নিরাপদে কুলুতে নেমে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

“তুমি সারাটা পথ এরকম পিঠ শক্ত করে বসে ছিলে কেন?”

মা বলল, “যদি দেখি যে ড্রাইভার খাদের দিকে চলেছে তাহলে দৌড়ে গিয়ে স্টিয়ারিংটা চেপে ধরতাম”|