ইতালি বেড়ানোটা প্রথম থেকেই বানচাল হয়ে যাচ্ছিল।
অয়নের একটা কনফারেন্স ছিল উত্তর ইতালির স্ট্রেসা শহরে। কথা ছিল আমরা দুজনেই যাব, কনফারেন্স হয়ে গেলে একটু এধার ওধার বেড়িয়ে আসব। বেশি দিন নয়, সপ্তাহ দুয়েক। দিল্লি থেকে এয়ার ইন্ডিয়া সরাসরি মিলানে যায়, ভাড়া একেবারে গগনচুম্বী নয়।
যেদিন রাতে বসে প্ল্যান করলাম, তার পরদিনই আমার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। তিনদিন পরে বাড়িতে আসলেও ওষুধের বোঝায় আমিই কুপোকাত। দিনে মাত্র কুড়িটা বড়ি খেতে হবে! কিছুদিন পরে সে সংখ্যাটা কমে দাঁড়াল ষোলো। রোজ আমাকে গিয়ে সব কটা বড়ি সাজিয়ে রেখে আসতে হয়।
আরো কিছুদিন পরে, যখন মা আর মা’র সহায়িকা মোটামুটি নিজেরা ওষুধের ব্যবস্থা করে নিতে পারল, আর একবার সবদিক পর্যালোচনা করে, ডাক্তারের সম্মতি নিয়ে প্লেনের টিকিটের দাম দেখলাম। আগে যা দেখেছিলাম ভাড়া তার প্রায় দেড়গুণ হয়ে গেছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা – ইতালির ভিসা অ্যাপয়ন্টমেন্ট প্রথম যে দিন পাওয়া যাচ্ছে সেটা কনফারেন্স হয়ে যাবার পরে। অয়নের শেঙ্গেন ভিসা আছে, ওর যেতে অসুবিধে নেই, কিন্তু আমার কি হবে?
একজন পরামর্শ দিল সুইজারল্যান্ডের ভিসা করতে, ওখানে নাকি অনেক ড়েট পাওয়া যাচ্ছে। দৌড়লাম ট্র্যাভেল এজেন্টের কাছে। মিলানে যাব, মিলান থেকে ফিরব, সুইজারল্যান্ড ভিসা দেবে কেন? ছেলেটি বলল, “দিদি, অনেকেই ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড যায়। আপনি হোটেল এমনভাবে রিসার্ভ করবেন, যাতে মনে হয় আপনি সুইজারল্যান্ডেই বেশি সময় থাকছেন, ইতালি শুধু আসা-যাওয়ার পথে পড়ছে”।
ভাগ্যিস এখন Booking.com-এ ক্যানসেল করতে পয়সা লাগে না। সব ব্যবস্থা করে সুইজারল্যান্ডের ভিসার জন্য ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে ইন্টারভিউ তো দিয়ে এলাম। সাত দিনে ভিসাও এসে গেল হাতে। চেয়েছিলাম দু বছরের ভিসা, পেলাম দু মাসের।
এয়ার ইন্ডিয়ার বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা আমার আছে। ২০১৮তে এই ফ্লাইটেই মিলান গেছিলাম। একেবারে ফাঁকা, ইচ্ছেমত যে কোনো সিটে বসা যায়। সেবার আমি একাই যাচ্ছিলাম। সামনের সিটের এক যাত্রীর হঠাৎ আমার সঙ্গে একটু রং-তামাশা করার বাসনা হয়েছিল। আমি একা তিনটে সিট দখল করে বসে আছি দেখে জিজ্ঞেস করেছিল আমার পাশে এসে বসতে পারে কি না! আমি বেশ উচ্চস্বরেই বলে উঠেছিলাম, “But, why?” আর কথা বাড়েনি তখন।
এবার ফ্লাইট কানায় কানায় ভরা। সিট পেলাম একেবারে শেষের দিকে। সামনের স্ক্রিন কাজ করে না, কোনো সিনেমা দেখার উপায় নেই, এমনকি ফ্লাইট ম্যাপটাও দেখা যায় না। বিমান সেবিকা বললেন, “তোমরা তোমাদের মোবাইল ফোনে সিনেমা দেখতে পার”। কিন্তু মোবাইল চার্জ দেবার ব্যবস্থা নেই – মানে, ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কাজ করে না। সেবিকা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন। জানতে চাইলেন আমি কি পানীয় পছন্দ করব। কমপেনসেশন কিনা জানি না, প্ল্যাস্টিকের গ্লাস ভর্তি করে জিন আর আস্ত একটা স্প্রাইটের ক্যান দিয়ে দিলেন।
পাকিস্তানের পথ এড়িয়ে, আমেদাবাদের পাশ দিয়ে, খাম্বাট উপসাগরের ওপর দিয়ে যাওয়া। আবহাওয়া এখন খারাপই থাকে, বৃষ্টির আগে আগে। প্লেন তো নাচতে নাচতে চলল বেশ অনেকক্ষণ। আমরা সিটের হাতল পাকড়ে বসে রইলাম, কি আর করব!
মিলানের এয়ারপোর্ট শহর থেকে অনেক দূরে। একটা এয়ারপোর্ট শাটল আছে যেটা সোজা ট্রেন স্টেশনে নিয়ে যায়। আমাদের হোটেল ট্রেন স্টেশনের কাছে। অচেনা জায়গায় আমার স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করে ব্যতিব্যস্ত করতে কোনো লজ্জা করে না। কিন্তু কিছু কিছু লোক আছে যারা ম্যাপ আর ডিরেকশন দেখতে দেখতে যেতে চায়, কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করায় বিশ্বাসী নয়। কয়েকবার লিফটে করে দু-তলা থেকে একতলা, আর একতলা থেকে তিনতলা ওঠানামা করার পরে আমি একটি অল্পবয়সী ছেলেকে পাকড়ালাম,
“Please tell me how to get to the airport shuttle to Milano Centrale”.
“Go to ground floor, out of gate number 4 and the buses are right there.”
এক রাত মিলানে কাটিয়ে পরদিন আমরা স্ট্রেসার ট্রেন ধরব। অনেক ট্রেন। সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া দুজনের জন্য 17 ইউরো। আর ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া 25 ইউরো। আমি তো লাফিয়ে উঠলাম, ফার্স্ট ক্লাসেই যাব। এইটুকু তো মাত্র তফাৎ, এটা আমরা দিতে পারি। না জানি সে কি সুন্দর ব্যবস্থা হবে। ইতালিতে কাউন্টার থেকে ট্রেনের টিকিট কাটলে আবার একটা validation-এর ঝামেলা আছে। Validation-এর দুঘন্টার মধ্যে ট্রেনে উঠতে হয়। Validation না করলে গুনগার দিতে হয়। সে অভিজ্ঞতাও হযেছিল পিসা যাবার পথে। কেউ আমাদের সবুজ মেশিনটা দেখিয়ে দেয়নি।
আমরা টিকিট কেটে, টিকিট validate করে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ট্রেনের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো বেশ কয়েকবার সুটকেস টেনে ঘুরে এলেও আমার সাধের ফার্স্ট ক্লাস আর চোখে পড়ে না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও কিছু সুরাহা হল না, কেউই কিছু বলতে পারল না। ট্রেনের কোনো গার্ড বা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। শেষে দূরে একজনকে দেখতে পেয়ে তাকেই ধরলাম,
“Which is the first class compartment?”
“There is no first class compartment in this train.”
“But I got a first class ticket at the counter. I asked the lady there, whether there is first class in this train, and she said there is”!
“In that case you ask the train manager”.
এই জন্যই বলে, কপালে নেই ঘি, ঠকঠকালে হবে কি! গুটি গুটি এসে একটা সিটে বসে পড়লাম। দুটো বড় আর একটা মেজো সুটকেস চারদিকে ছড়িয়ে রইল। জানলার কাঁচে দাগ, কিছু দেখা যায় না। উত্তপ্ত মেজাজ নিয়ে স্ট্রেসায় নামলাম।
স্ট্রেসা ইতালির উত্তর দিকে, সুইজারল্যান্ডের সীমানা থেকে খুব দূর নয়। Lake Maggiore-র ধারে। আমাদের হোটেলটাও লেকের ধারেই একেবারে, আমাদের ঘর চারতলায়। ম্যানেজার প্রথমেই বলে দিল, “We do not have any elevator. Your room is on the back side of the hotel, you will get a side view of the lake”। সুটকেশ তো সে তুলে দিল নাহয়, কিন্তু উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে দিনে দু-তিন বার ওঠানামা আমাদের ষাট-বছুরে হাঁটুতে সইলে হয়!
স্ট্রেসাতে থাকাকালীন একদিন ভোর সাড়ে-চারটের সময় কন্যার ফোন, “দিদার খুব শরীর খারাপ, শোভামাসি ফোন করেছিল”। আমি তো প্রায় ফিরে যাব কিনা ভাবতে বসেছিলাম। যা হোক, Support Elders আর ডাক্তারের সহায়তায় সে ধাক্কা সামলে নেওয়া গেল। ঠিক করলাম তাহলে একদিন Switzerland-এর Locarno নামে এক জায়গায় বেড়িয়ে আসব। ট্রেনে যাব, ফিরব ফেরি করে, Lake Maggiore-র উত্তর থেকে দক্ষিণে। হোটেলের পাশেই ট্রাভেল এজেন্টের অফিস, দুটো টিকিট কেটে ফেললাম। পরদিন সকাল সকাল বেরোতে হবে, সাড়ে ন’টায় ট্রেন।
সারা রাত অঝোর বৃষ্টি। ছাতা মাথায়, জুতো মোজা ভিজিয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম ঠিক সময়ে, কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। মাঝে মাঝে ইতালিয়ান ভাষায় কিছু একটা announcement হচ্ছে, কিন্তু আমরা ভালো বুঝতে পারছি না। আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে একই ট্রেন ধরবে বলে। তারা বলছে বৃষ্টির জন্য দেরি হচ্ছে, এসে যাবে। কারোরই বিশেষ কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না। এমন সময়ে অ্যানাউন্স করল যে গতকালের বৃষ্টিতে গাছ পড়ে লাইন বন্ধ, ট্রেন ক্যানসেল। আমাদের বনগাঁ লাইনের মতোই আর কি!
অতঃ কিম্? যতই হোক ইউরোপ তো। স্টেশনে একটা চার্ট ঝোলানো আছে যেখানে ওই স্টেশনে যত ট্রেন যায় তার নম্বর আর সময় লেখা। দেখলাম সাড়ে দশটায় একটা ট্রেন আছে, অগত্যা সেটাই ধরতে হবে। তাও কি মনে করে ট্র্যাভেল এজেন্টকে একটা ফোন করলাম, কারণ দেখলাম আরো যারা এই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল তারা সবাই প্ল্যাটফর্ম থেকে চলে গেল। ভাগ্যিস ফোন করেছিলাম! ট্র্যাভেল এজেন্টের থেকে জানলাম যে সাড়ে দশটার ট্রেন রোজ যায় না, সেটা আমরা খেয়াল করিনি। কিন্তু ইতালিতে ট্রেন-বাস বলে একটা সিস্টেম আছে। ট্রেন ক্যানসেল হলে এবং যদি দূরত্ব খুব বেশি না হয়, ট্রেন কোম্পানিই বাসে করে গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে দেয়। এগারোটার সময় যদি আমরা স্টেশনের বাইরে দাঁড়াই, তা হলে বাসে করে Domodossola চলে যাব, সেখান থেকে Locarno-র ট্রেন পাব। যে ট্রেনটায় যাব ভেবেছিলাম সেটা পাব না, কিন্তু পরেরটা ধরতে অসুবিধে হবে না।
শেষ পর্যন্ত তাই হল। Locarno জায়গাটা সুন্দর। ট্রেনের পথটাও সুন্দর, Switzerland বলে কথা। কিন্তু যাতায়াতই সার। মাত্র দেড় ঘন্টা সময় Locarno-তে কাটিয়ে, McDonalds-এর Big Mac আর French Fry খেয়ে ফেরিতে চড়তে হল।
Itali
Ore baba, e to amar bhul ke onayase 10 goal debe. Tobe sob kichu to bhul noy, kopal er gero. E guloi kintu beranor upri paona
Soma
14-07-2025 09:49:56