বেড়ানোর ডায়েরি: ৩


#italy #travel #adventure

ইতালি বেড়ানোটা প্রথম থেকেই বানচাল হয়ে যাচ্ছিল।

অয়নের একটা কনফারেন্স ছিল উত্তর ইতালির স্ট্রেসা শহরে। কথা ছিল আমরা দুজনেই যাব, কনফারেন্স হয়ে গেলে একটু এধার ওধার বেড়িয়ে আসব। বেশি দিন নয়, সপ্তাহ দুয়েক। দিল্লি থেকে এয়ার ইন্ডিয়া সরাসরি মিলানে যায়, ভাড়া একেবারে গগনচুম্বী নয়।

যেদিন রাতে বসে প্ল্যান করলাম, তার পরদিনই আমার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। তিনদিন পরে বাড়িতে আসলেও ওষুধের বোঝায় আমিই কুপোকাত। দিনে মাত্র কুড়িটা বড়ি খেতে হবে! কিছুদিন পরে সে সংখ্যাটা কমে দাঁড়াল ষোলো। রোজ আমাকে গিয়ে সব কটা বড়ি সাজিয়ে রেখে আসতে হয়।

আরো কিছুদিন পরে, যখন মা আর মা’র সহায়িকা মোটামুটি নিজেরা ওষুধের ব্যবস্থা করে নিতে পারল, আর একবার সবদিক পর্যালোচনা করে, ডাক্তারের সম্মতি নিয়ে প্লেনের টিকিটের দাম দেখলাম। আগে যা দেখেছিলাম ভাড়া তার প্রায় দেড়গুণ হয়ে গেছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা – ইতালির ভিসা অ্যাপয়ন্টমেন্ট প্রথম যে দিন পাওয়া যাচ্ছে সেটা কনফারেন্স হয়ে যাবার পরে। অয়নের শেঙ্গেন ভিসা আছে, ওর যেতে অসুবিধে নেই, কিন্তু আমার কি হবে?

একজন পরামর্শ দিল সুইজারল্যান্ডের ভিসা করতে, ওখানে নাকি অনেক ড়েট পাওয়া যাচ্ছে। দৌড়লাম ট্র্যাভেল এজেন্টের কাছে। মিলানে যাব, মিলান থেকে ফিরব, সুইজারল্যান্ড ভিসা দেবে কেন? ছেলেটি বলল, “দিদি, অনেকেই ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড যায়। আপনি হোটেল এমনভাবে রিসার্ভ করবেন, যাতে মনে হয় আপনি সুইজারল্যান্ডেই বেশি সময় থাকছেন, ইতালি শুধু আসা-যাওয়ার পথে পড়ছে”।

ভাগ্যিস এখন Booking.com-এ ক্যানসেল করতে পয়সা লাগে না। সব ব্যবস্থা করে সুইজারল্যান্ডের ভিসার জন্য ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে ইন্টারভিউ তো দিয়ে এলাম। সাত দিনে ভিসাও এসে গেল হাতে। চেয়েছিলাম দু বছরের ভিসা, পেলাম দু মাসের।

এয়ার ইন্ডিয়ার বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা আমার আছে। ২০১৮তে এই ফ্লাইটেই মিলান গেছিলাম। একেবারে ফাঁকা, ইচ্ছেমত যে কোনো সিটে বসা যায়। সেবার আমি একাই যাচ্ছিলাম। সামনের সিটের এক যাত্রীর হঠাৎ আমার সঙ্গে একটু রং-তামাশা করার বাসনা হয়েছিল। আমি একা তিনটে সিট দখল করে বসে আছি দেখে জিজ্ঞেস করেছিল আমার পাশে এসে বসতে পারে কি না! আমি বেশ উচ্চস্বরেই বলে উঠেছিলাম, “But, why?” আর কথা বাড়েনি তখন।

এবার ফ্লাইট কানায় কানায় ভরা। সিট পেলাম একেবারে শেষের দিকে। সামনের স্ক্রিন কাজ করে না, কোনো সিনেমা দেখার উপায় নেই, এমনকি ফ্লাইট ম্যাপটাও দেখা যায় না। বিমান সেবিকা বললেন, “তোমরা তোমাদের মোবাইল ফোনে সিনেমা দেখতে পার”। কিন্তু মোবাইল চার্জ দেবার ব্যবস্থা নেই – মানে, ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কাজ করে না। সেবিকা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন। জানতে চাইলেন আমি কি পানীয় পছন্দ করব। কমপেনসেশন কিনা জানি না, প্ল্যাস্টিকের গ্লাস ভর্তি করে জিন আর আস্ত একটা স্প্রাইটের ক্যান দিয়ে দিলেন।

পাকিস্তানের পথ এড়িয়ে, আমেদাবাদের পাশ দিয়ে, খাম্বাট উপসাগরের ওপর দিয়ে যাওয়া। আবহাওয়া এখন খারাপই থাকে, বৃষ্টির আগে আগে। প্লেন তো নাচতে নাচতে চলল বেশ অনেকক্ষণ। আমরা সিটের হাতল পাকড়ে বসে রইলাম, কি আর করব!

মিলানের এয়ারপোর্ট শহর থেকে অনেক দূরে। একটা এয়ারপোর্ট শাটল আছে যেটা সোজা ট্রেন স্টেশনে নিয়ে যায়। আমাদের হোটেল ট্রেন স্টেশনের কাছে। অচেনা জায়গায় আমার স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করে ব্যতিব্যস্ত করতে কোনো লজ্জা করে না। কিন্তু কিছু কিছু লোক আছে যারা ম্যাপ আর ডিরেকশন দেখতে দেখতে যেতে চায়, কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করায় বিশ্বাসী নয়। কয়েকবার লিফটে করে দু-তলা থেকে একতলা, আর একতলা থেকে তিনতলা ওঠানামা করার পরে আমি একটি অল্পবয়সী ছেলেকে পাকড়ালাম,

“Please tell me how to get to the airport shuttle to Milano Centrale”.

“Go to ground floor, out of gate number 4 and the buses are right there.”

এক রাত মিলানে কাটিয়ে পরদিন আমরা স্ট্রেসার ট্রেন ধরব। অনেক ট্রেন। সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া দুজনের জন্য 17 ইউরো। আর ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া 25 ইউরো। আমি তো লাফিয়ে উঠলাম, ফার্স্ট ক্লাসেই যাব। এইটুকু তো মাত্র তফাৎ, এটা আমরা দিতে পারি। না জানি সে কি সুন্দর ব্যবস্থা হবে। ইতালিতে কাউন্টার থেকে ট্রেনের টিকিট কাটলে আবার একটা validation-এর ঝামেলা আছে। Validation-এর দুঘন্টার মধ্যে ট্রেনে উঠতে হয়। Validation না করলে গুনগার দিতে হয়। সে অভিজ্ঞতাও হযেছিল পিসা যাবার পথে। কেউ আমাদের সবুজ মেশিনটা দেখিয়ে দেয়নি।

আমরা টিকিট কেটে, টিকিট validate করে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ট্রেনের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো বেশ কয়েকবার সুটকেস টেনে ঘুরে এলেও আমার সাধের ফার্স্ট ক্লাস আর চোখে পড়ে না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও কিছু সুরাহা হল না, কেউই কিছু বলতে পারল না। ট্রেনের কোনো গার্ড বা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। শেষে দূরে একজনকে দেখতে পেয়ে তাকেই ধরলাম,

“Which is the first class compartment?”

“There is no first class compartment in this train.”

“But I got a first class ticket at the counter. I asked the lady there, whether there is first class in this train, and she said there is”!

“In that case you ask the train manager”.

এই জন্যই বলে, কপালে নেই ঘি, ঠকঠকালে হবে কি! গুটি গুটি এসে একটা সিটে বসে পড়লাম। দুটো বড় আর একটা মেজো সুটকেস চারদিকে ছড়িয়ে রইল। জানলার কাঁচে দাগ, কিছু দেখা যায় না। উত্তপ্ত মেজাজ নিয়ে স্ট্রেসায় নামলাম।

         স্ট্রেসা ইতালির উত্তর দিকে, সুইজারল্যান্ডের সীমানা থেকে খুব দূর নয়। Lake Maggiore-র ধারে। আমাদের হোটেলটাও লেকের ধারেই একেবারে, আমাদের ঘর চারতলায়। ম্যানেজার প্রথমেই বলে দিল, “We do not have any elevator. Your room is on the back side of the hotel, you will get a side view of the lake”। সুটকেশ তো সে তুলে দিল নাহয়, কিন্তু উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে দিনে দু-তিন বার ওঠানামা আমাদের ষাট-বছুরে হাঁটুতে সইলে হয়!

স্ট্রেসাতে থাকাকালীন একদিন ভোর সাড়ে-চারটের সময় কন্যার ফোন, “দিদার খুব শরীর খারাপ, শোভামাসি ফোন করেছিল”। আমি তো প্রায় ফিরে যাব কিনা ভাবতে বসেছিলাম। যা হোক, Support Elders আর ডাক্তারের সহায়তায় সে ধাক্কা সামলে নেওয়া গেল। ঠিক করলাম তাহলে একদিন Switzerland-এর Locarno নামে এক জায়গায় বেড়িয়ে আসব। ট্রেনে যাব, ফিরব ফেরি করে, Lake Maggiore-র উত্তর থেকে দক্ষিণে। হোটেলের পাশেই ট্রাভেল এজেন্টের অফিস, দুটো টিকিট কেটে ফেললাম। পরদিন সকাল সকাল বেরোতে হবে, সাড়ে ন’টায় ট্রেন।

সারা রাত অঝোর বৃষ্টি। ছাতা মাথায়, জুতো মোজা ভিজিয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম ঠিক সময়ে, কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। মাঝে মাঝে ইতালিয়ান ভাষায় কিছু একটা announcement হচ্ছে, কিন্তু আমরা ভালো বুঝতে পারছি না। আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে একই ট্রেন ধরবে বলে। তারা বলছে বৃষ্টির জন্য দেরি হচ্ছে, এসে যাবে। কারোরই বিশেষ কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না। এমন সময়ে অ্যানাউন্স করল যে গতকালের বৃষ্টিতে গাছ পড়ে লাইন বন্ধ, ট্রেন ক্যানসেল। আমাদের বনগাঁ লাইনের মতোই আর কি!

অতঃ কিম্‍? যতই হোক ইউরোপ তো। স্টেশনে একটা চার্ট ঝোলানো আছে যেখানে ওই স্টেশনে যত ট্রেন যায় তার নম্বর আর সময় লেখা। দেখলাম সাড়ে দশটায় একটা ট্রেন আছে, অগত্যা সেটাই ধরতে হবে। তাও কি মনে করে ট্র্যাভেল এজেন্টকে একটা ফোন করলাম, কারণ দেখলাম আরো যারা এই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল তারা সবাই প্ল্যাটফর্ম থেকে চলে গেল। ভাগ্যিস ফোন করেছিলাম! ট্র্যাভেল এজেন্টের থেকে জানলাম যে সাড়ে দশটার ট্রেন রোজ যায় না, সেটা আমরা খেয়াল করিনি। কিন্তু ইতালিতে ট্রেন-বাস বলে একটা সিস্টেম আছে। ট্রেন ক্যানসেল হলে এবং যদি দূরত্ব খুব বেশি না হয়, ট্রেন কোম্পানিই বাসে করে গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে দেয়। এগারোটার সময় যদি আমরা স্টেশনের বাইরে দাঁড়াই, তা হলে বাসে করে Domodossola চলে যাব, সেখান থেকে Locarno-র ট্রেন পাব। যে ট্রেনটায় যাব ভেবেছিলাম সেটা পাব না, কিন্তু পরেরটা ধরতে অসুবিধে হবে না।

শেষ পর্যন্ত তাই হল। Locarno জায়গাটা সুন্দর। ট্রেনের পথটাও সুন্দর, Switzerland বলে কথা। কিন্তু যাতায়াতই সার। মাত্র দেড় ঘন্টা সময় Locarno-তে কাটিয়ে, McDonalds-এর Big Mac আর French Fry খেয়ে ফেরিতে চড়তে হল।

 

 

Lake Maggiore

 

ইতালিতে আমাদের দেশের মত ট্রেন স্ট্রাইকও হয়। আকস্মিক বন্ধ্ নয়, রীতিমত প্ল্যান করে, কখনো কখনো একদিনের বদলে অন্য দিন। ১৭ মে নাকি একটা ট্রেন ধর্মঘটের কথা ছিল, কোনো কারণে সেদিন হয়নি, পেছিয়ে দিন স্থির হল ২৩ মে, যেদিন আমরা স্ট্রেসা থেকে ট্রেনে করে ফ্লোরেন্স যাব। একটা ট্রেনে হবে না, স্ট্রেসা থেকে মিলান, মিলান থেকে ফ্লোরেন্স। কেউ ভালো করে বলতে পারছে না ট্রেন স্ট্রাইক মানে কি? সব ট্রেন বন্ধ, কয়েকটা ট্রেন বন্ধ, কখন থেকে কখন ট্রেন বন্ধ, টিকিট বা রিসার্ভেশন থাকলে কি হবে – কিছুই ভালো করে বুঝতে পারছি না। সাধারনত কনফারেন্সের আয়োজকরা সাহায্য করে – সেখান থেকেও বিশেষ কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত জানা গেল যে ট্রেন স্ট্রাইক হলেও, যে সব ট্রেন সকাল ন’টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছবে, আর যেসব ট্রেন সন্ধে ছটার পরে রওনা হবে, সেগুলো চলবে। বেশ কিছু দূরপাল্লার ট্রেনও চলবে – যেমন মিলান থেকে ভেনিস। আমরা তো স্ট্রাইকের ভয়ে বাসের টিকিট কেটে ফেলেছি ততক্ষণে, আমাদের আর কিছু করার নেই। ট্রেনে মিলান থেকে ফ্লোরেন্স যেতে লাগে হয়ত আড়াই ঘন্টা, আমাদের বাস লেট করল দেড় ঘন্টা, তারপরে যেতে লাগল আরো পাঁচ ঘন্টা। ইতালিতে সব বড় শহরে ট্রেন স্টেশন শহরের মধ্যে, বাস স্টেশন শহরের বাইরে, যাতে পলিউশন কমে। আমাদের হোটেল শহরের সব চেয়ে জমজমাট অঞ্চলে, ট্রেন স্টেশন থেকে হাঁটা পথে কুড়ি মিনিট। বাস স্টেশন থেকে আনেক দূর। দুটো বড় সুটকেস, একটা ছোট সুটকেস, অয়নের ল্যাপটপের ব্যাকপ্যাক ইত্যাদি নিয়ে লড়ঝড় করতে করতে ট্যাক্সিতে উঠলাম।

ইউরোপের শহরগুলো আয়তনে ছোট, বিশেষ করে ফ্লোরেন্সের মত বহু পুরনো শহর, যার ঐতিহাসিক অঞ্চল পুরোটাই UNESCO World Heritage Site। সরু cobble stone বসানো রাস্তা, পুরনো বাড়ি, অজস্র দোকান, প্রধানত খাবার দোকান আর ক্যাফে, রাস্তায় বসেই খাবার ব্যবস্থা, গাড়ি যাবার জায়গা নেই, দুটো গাড়ি যাওয়া তো সম্ভবই নয়। এইরকম একটা রাস্তায় ট্যাক্সি আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল, যদিও আস্তানাটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। ড্রাইভার মহিলা আশ্বস্ত করলেন যে আমরা ঠিকই এসেছি।

হাতে Google Map নিয়ে একটু এধার-ওধার ঘোরাঘুরি করছি, হঠাৎ অয়ন বলে উঠল

“আমার ল্যাপটপ ব্যাগ কোথায়? তোমার কাছে”?

“কই, না তো! ব্যাগ তো ক্যাবের ভেতরে ছিল, বুটিতে তো দেওয়া হয়নি”।

“তাহলে নামানো হয়নি নিশ্চয়। বুটি থেকে তো সব গুনে গুনে নামানো হয়েছিল”।

“এখন কি হবে? এ তো app cab নয়, যে আমরা track করতে পারব”।

এর মধ্যে আস্তানাটা খুঁজে পেয়েছি। যেখানে নেমেছিলাম, ঠিক সেখানেই, নম্বরটা দেখতে পাইনি আগে। এটা ঠিক হোটেল নয়, একটা প্রকান্ড বাড়ির এক এক অংশ এক একটা অ্যাপার্টমেন্ট হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। পরে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে জেনেছিলাম বাড়িটা খুবই পুরনো, হয়ত অষ্টাদশ শতকের। বাড়িতে ঢুকে চাবি নিয়ে প্রথমেই receptionist-কে বললাম

“We need a help. My husband’s laptop bag has been left in the cab. Is there any way we can get it back”?

“Is it an app cab”?

“No Madam”

“Did you notice the cab number?”

“No Madam”

“Did you, by any chance, know the driver’s name?”

“No Madam”

“Ok, let me see what can be done about it.”

মেয়েটির নাম Marzia. আমি ভেবেছিলাম সে হয়ত পুলিশকে ফোন করবে। তা না করে, সে শহরের ট্যাক্সি নেটওয়ার্ককে ফোন করল -- বাস স্টেশন থেকে দুজন যাত্রী উঠেছে, এসেছে অমুক ঠিকানায়, এই সময় থেকে এই সময় ট্যাক্সিতে ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্যাক্সি নেটওয়ার্ক আমাদের ড্রাইভার মহিলাকে খুঁজে দিল। তিনিও আমাদের সনাক্ত করলেন, কিন্তু বললেন যে কোনো ব্যাগ গাড়ির পেছনের সীটে পড়ে নেই।

আমরা ব্যাগের আশা ছেড়েই দিলাম। তবুও ভাবছি তা হলে কি বাস স্টেশনেই পড়ে রইল, একবার কি যাব, সে অনেক দূর, এখন গেলে কি পাওয়া যাবে? ইতালিতে আমাদের আগের অভিজ্ঞতা ভালো নয়, ট্রামে আমার ব্যাগ ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়েছিল। সন্দেহ হচ্ছিল বলে তৈরী ছিলাম, এগিয়ে আসা হাতটায় সজোরে একটি চপেটাঘাত করতে হয়েছিল। আর এ তো একটা আস্ত পড়ে থাকা ল্যাপটপ!

এত কথা ভাবতে ভাবতে Marzia-র ফোন বেজে উঠল। আমাদের ড্রাইভার ফোন করে বলছেন যে সীটে সত্যিই একটা কালো ব্যাগ পড়ে আছে। কালো সীটের ওপর তিনি আগে ঠিক ঠাওর করতে পারেননি। এখন আসছেন ব্যাগ নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে, যেন আমরা ঘন্টা খানেক পরে নীচে দাঁড়াই, ব্যাগ identify করতে হবে।

 

 

Florence Cathedral

 

ফ্লোরেন্সে ছিলাম পাঁচদিন। আরো পাঁচদিন থাকলেও ফ্লোরেন্স দেখা শেষ হত না। তার মধ্যে গেলাম পিসা আর সিয়েনার ক্যাথিড্রাল দেখতে। তারপর ভেনিস।

ভেনিসে না গেলে ভেনিস কেমন বোঝা যায় না। বাড়িগুলো জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে, এক পা অন্তর অন্তর একটা করে ব্রিজ – সিঁড়ি দিয়ে ওঠো, তিন পা সোজা হাঁটো, আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাও। গাড়ি তো চলেই না, এমনকি সাইকেলও চলতে পারে না। বিশেষ ভাবে সক্ষমরা কেমন করে wheelchair নিয়ে চলবে তাও বুঝতে পারলাম না, যদিও একটি ছেলেকে wheelchair নিয়ে Vaporato, বা Water Bus-এ একবার চড়তে দেখেছি। কোনো কোনো ব্রিজের পাশে ramp চোখে পড়েছে, কিন্তু সে ব্যতিক্রম।

যাই হোক, এ তো পরের কথা, যখন আমরা হোটেলে সুটকেস রেখে চরতে বেরিয়েছি। হোটেলে পৌঁছনই তো বিরাট ব্যাপার। ট্রেন থেকে নেমে সামনে ক্যানেল, পরে জানলাম তার নামই Grand Canal, জেমস বন্ড যেখানে মোটরবোট নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করে। কিভাবে হোটেলে যাব? Google বলেন হেঁটে যেতে ২০ মিনিট লাগবে। একজন water taxi চালক বলল হোটেলে যেতে 70 euro নেবে। শুনেই আমার সঙ্গী সুটকেস নিয়ে হাঁটা লাগাল। ব্রিজ বেয়ে ওঠা, আর ব্রিজ বেয়ে নামা, এক পা এগিয়ে, আবার ওজনদার সুটকেস হাতে তুলে আবার ব্রিজ বেয়ে ওঠা, আবার ব্রিজ বেয়ে নামা। অন্তত ১৫ – ২০ মিনিট এভাবে চলার পর গলদঘর্ম হয়ে একজায়গায় এসে দেখলাম সেই Grand Canal-এই হাঁটা পথ শেষ, এবার যেতে হলে রামকৃষ্ণের মত জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে হবে। লোকে গন্ডোলা চড়বে বলে লাইন লাগিয়েছে। এতো মালপত্র নিয়ে তো তাতে চড়া সম্ভব নয়। এবার?

ওই যে বলেছিলাম না, আমি রাস্তা চলতে চলতে যাকে পারি পথ শুধিয়ে নিই। কিন্তু কিছু বিশেষ লোক আছে, যারা Map-Happy।  Google থাকতে কাউকে শুধোবার দরকার কি? এবার আমি হাল ধরলাম – প্রথমে হোটেলকে ফোন করা হল, যেটা আমাদের ট্রেন স্টেশনেই করা উচিত ছিল। হোটেল বলল ওখান থেকে একটা Vaporato ধরলে তিনটে স্টপ। যেখানে এসে আটকে গেছি সেখান থেকে Vaporato দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু যেতে হলে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে। আবার সুটকেস টেনে যাত্রা শুরু হল। এবার পথ হারিয়ে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সেখানে দুজন সুবেশ ভদ্রলোক বোধহয় লাঞ্চে যাচ্ছিলেন, কিংবা লাঞ্চ থেকে ফিরছিলেন। তাঁদের ওপর চড়াও হয়ে কোন গলি দিয়ে কোথায় যাব, খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিতে বলায়, তাঁরা খানিকটা পথ এগিয়েও দিলেন। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, ভেনিসের গলি কাশীর গলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। ষাঁড় আর গোবরের উপস্থিতি বাদ দিয়ে অবশ্য!

Vaporato স্টপে যাবার পথে অয়ন যাচ্ছিল আমার সামনে সামনে। মাঝখানে কোথা থেকে একদল বিভিন্ন বয়সী মহিলা এসে পড়লেন, চলেও গেলেন। রাস্তা ফাঁকা। হঠাৎ দেখি একটি প্রাচ্য-মুখী অল্পবয়সী মেয়ে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে আমাকে পেরিয়ে অয়নের কাছে গিয়ে বলছে,

“Excuse me, is this your wallet? It fell on the road.”

বলেই আবার দৌড়তে দৌড়তে চলে গেল।

আমরা হতভম্ব।

এখন কথা হল, অয়নের পকেটের ভেতর থেকে মনিব্যাগ পড়ে যাওয়া অসম্ভব। পকেটে ফুটো নেই। তাহলে যে কয়েক সেকেন্ড অয়নের আর আমার মধ্যে মহিলাদের দলটা চলে এসেছিল - যার মধ্যে এই মেয়েটিকেও আমি লক্ষ্য করেছিলাম, একটা স্কার্ফ নাড়াচাড়া করছিল – সেই সময়টুকুর মধ্যেই কেউ ব্যাগটা পকেট থেকে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু তাহলে ফিরিয়ে দিল কেন? ক্যাশ এবং কার্ড দুইই অক্ষত ছিল।

এর পরেও হোটেলে পৌঁছনের আগে আরো অ্যাডভেঞ্চার বরাদ্দ ছিল। ভুল টিকিট কেটে গেট খুলে ঢুকেছি, কিন্তু বেরতে আর পারি না। শেষে গেটের তলা দিয়ে হামাগুড়ি দিতে হল!

 

Rialto Bridge, Venice

 

এতো রকম অভিজ্ঞতার পরে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট। সে মাত্র সাত ঘন্টা লেট ছিল। কিন্তু অক্ষত অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে। এর বেশি আর কি চাইতে পারে মানুষ?