জন্মদিন রবীন্দ্রনাথ ও সাতকাহন


#

যেদিন শিশু ভূমিষ্ঠ হয় সেদিন তার জন্মদিন বলে ধরা হয়। কিন্তু সেই প্রাণটির বীজ বপন হয়ে থাকে বহু দিন আগে। তার সেই নিভৃতে বেড়ে ওঠার সাক্ষী থাকে মাত্র গুটিকয়েক মানুষ। তারপর যেদিন সে সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে ঘোষণা করে নিজের আবির্ভাব ক্ষণ, সেদিনটি উদযাপিত হয় তার জন্মদিন হিসেবে। একটি আপাত অপ্রাসঙ্গিক গল্প বলি। আমার ছেলের জন্মের তারিখ ধার্য হলো ৬ই মে। আমি ডাক্তারকে বললাম ওটা পিছিয়ে ৮ করা যায় না?  ডাক্তার, যিনি তাঁর মেজাজের জন্য কুখ্যাত, এ হেন প্রস্তাবে হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন বলো তো? আমি বললাম, আসলে ৮ই মে তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। উনি ভয়ঙ্কর চিৎকার করে বললেন, তোমার ডাক্তারি ডিগ্রী কেড়ে নেওয়া উচিত।

যাক সে কথা, জন্মদিন প্রসঙ্গে আসি। মানুষের জন্মের মতোই কোনো ব্যবসা, কোনো দোকান বা কোনো বই, সব কিছুই যেদিন  পৃথিবীর আলো দেখে, সেদিনটি  তার জন্মদিন বলে উদযাপিত হয়। কিন্তু তার বীজ নিহিত থাকে অনেক গভীরে। প্রতিটি প্রকাশ বহু নিভৃত যাপনের ফসল।

সাতকাহন ও তার ব্যতিক্রম নয়। ৩০শে মে সাতকাহনের জন্মদিন। কিন্তু কবে যে এর সূচনা তা কেই বা জানে! সে কি শ্রবসীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সূত্রপাতের সময়, না কি  বন্দনাদি, সুতপাদি, কল্পনাদি, দেবীকাদি র তত্ত্বাবধানে স্কুল ম্যাগাজিন সম্পাদনার সময়, না কি বাড়িতে মা র কঠোর অনুশাসনে বার বার এক লেখা পরিমার্জনা করার সময়, তা বলা মুশকিল।

ব্লগ এর কথা শুনেছি বহু বছর আগে। আমার বান্ধবী এবং তৎকালীন  সহকর্মী ডাঃ সোমা দাস আমাকে প্রথম ব্লগ লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। তখন মেদিনীপুরে পোস্টিং। চাকরি এবং সংসার সামলে আর কিছু করার কথা ভাবতেই গায়ে জ্বর। তাছাড়া আন্তর্জাল তখন এতটা সহজলভ্য ও সহজ সাধ্য ছিল না। এর প্রায় দশ বছর বাদে আলাপ হয় গ্লোবাল স্কেচ এর সায়ক এর সঙ্গে। ওর সাহায্য ছাড়া ব্লগ তৈরী সম্ভব ছিল না। শুরু হলো সাতকাহন, ৩০ শে মে, ২০২০। এই তারিখ কিন্তু কোনো পাঁজি পুঁথি, দিন ক্ষণ মেনে ঠিক হয় নি। হঠাৎই জানতে পারলাম লেখালিখির জগতে এই দিনটির বিশেষ ভূমিকা আছে।

১৮২৬ সালে এই দিনটিতে কলকাতায় প্রকাশিত হয় প্রথম হিন্দি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। নাম, উড়ন্ত মার্তন্ড। সম্পাদক? বিশ্বাস করবেন? দুই বন্ধু, পন্ডিত শ্রীধর শুক্ল আর মুন্নু ঠাকুর। যদিও পন্ডিত শুক্লর খ্যাতি, পরিচিতি দুইই বেশি থাকায় সকলে সম্পাদক হিসেবে তাঁর নামই মনে রেখেছে। এই দিনটি "হিন্দি পত্রকারিতা দিবস" হিসেবে আজও প্রতিপালিত হয়।

এখানেই শেষ নয়. ৩০শে মে র আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে অহিংস, নিরস্ত্র ভারতীয়র ওপর গুলিবৃষ্টি করা হয়। নিহত হয় হাজারের বেশি মানুষ, আহত ততোধিক। এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে কবিগুরু হাতে তুলে নেন তাঁর অমোঘ আয়ুধ, তাঁর কলম। নোবেল জয়ী কবি হিসেবে নয়, ব্রিটিশ রাজ্যের নাইট হিসেবে চিঠি লেখেন তৎকালীন ভাইসরয় কে ১৯১৯ সালের ৩০শে মে। এই চিঠিটি শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয়, সাহিত্যজগতে একটি অমূল্য রত্ন। তিনি লেখেন, “I for my part wish to stand shorn of all special distinctions by the side of my countrymen who for their so called insignificance are liable to suffer a degradation, not fit for human beings.” চিঠির পরবর্তী অংশে তিনি তাঁর নাইট উপাধি ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করেন।

এইভাবে সাতকাহনের জন্মদিনে জুড়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই বদমেজাজি ডাক্তার আমার ছেলের জন্মদিনকে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের সাথে জুড়ে দিতে আপত্তি জানালে কি হবে, (ডাক্তার হিসেবে তিনি ঠিক কাজ ই করেছিলেন), "আমার ঘর বান্ধিবি, পথ বান্ধিবি, কপাল বান্ধিবি কেমনে!"

সাতকাহনের সব পাঠককে আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে অনেক ভালোবাসা।