বড় পাপ হে


#

৩০২০ চান্দ্রবর্ষ , তৃতীয় মাস,  দশম দিবস, প্রভাতী সংশপ্তক:

...বিশেষ সূত্রে পাওয়া একটি খবরে প্রকাশ যে, গত একমাসে সন্মার্গ গ্রামের দশটি হাসপাতালে মোট একশত শিশু ভূমিষ্ঠ হইয়াছে এবং প্রতিটি শিশুই জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। কোন কোন শিশুর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও বর্তমান। ঐ অঞ্চলের পরিবেশ-বিজ্ঞানীগণ ইহার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিশেষরূপে তৎপর হইয়াছেন। তাঁহারা আশঙ্কা করিতেছেন যে, ঐ অঞ্চলের জলবায়ুর ক্ষেত্রে  কোন আকস্মিক পরিবর্তনের নিমিত্ত এইরূপ হওয়া সম্ভব।...

 

৩০২১ চান্দ্রবর্ষ , নবম মাস,  দ্বাদশ দিবস, সান্ধ্য সংবর্ত:

...দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গত দেড় বৎসর যাবৎ যত শিশু ভূমিষ্ঠ হইতেছে, তাহারা অধিকাংশই বিকলাঙ্গ এবং মানসিক প্রতিবন্ধী বলিয়া প্রমাণিত হইতেছে। সদ্যোজাত শিশুমৃত্যুর হার এবং পঞ্চম বৎসর পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পাইতেছে। অথচ গর্ভবতী মায়েদের কোন শারীরিক ত্রুটি বা প্রসবকালীন জটিলতা এই শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী বলিয়া ডাক্তারগণ মনে করেন না। বস্তুতঃ বহু অনুসন্ধান সত্ত্বেও এই ভয়ানক সমস্যাটির প্রতি কোন আলোকপাতই এযাবৎ সম্ভব হয় নাই। এই ব্যাপারে গবেষণাবাবদ সরকারী তহবিল হইতে ত্রিশ লক্ষ কার্ষাপণ নির্ধারিত হইয়াছে।...

 

৩০২২ চান্দ্রবর্ষ , একাদশ মাস,  ষোড়শ দিবস, প্রভাতী শঙ্খনাদ:

...বিগত বৎসরের সর্বাধিক জটিল সমস্যাটি প্রসঙ্গে আজ কিঞ্চিৎ আলোকপাত করিতে সক্ষম হইয়াছেন ডাঃ যুবনাশ্ব। তিনি রৈবতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি বিভাগীয় প্রধান। তাঁহার মতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া রমণীগণ সামাজিক অবহেলার শিকার। এই অবহেলা তাহাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহা প্রতিবাদের আকার ধারণ করে নাই। সমাজের ক্রমোন্নতির সহিত রমণীদিগের প্রতি অপমান এবং অবহেলার ধরণও ক্রমশঃ উন্নত হইয়াছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়। গর্ভরস বিশ্লেষণ পূর্বক এবং শব্দোত্তর তরঙ্গ প্রয়োগে গর্ভস্থ সন্তানের সঠিক লিঙ্গ-নির্ধারণ খুবই সহজ হইয়া যায়। এই সময়ে নানা কারণে গর্ভস্থ কন্যাভ্রূণ হত্যার পরিমাণ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এইভাবে কন্যাসন্তানের জন্মের আনুপাতিক হার হ্রাস পায়। পুত্র এবং কন্যার প্রতি পিতামাতার বৈষম্যমূলক আচরণ, সামাজিক অবক্ষয়ের সহিত রমণীগণের প্রতি সামাজিক লাঞ্ছনা যেমন ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি এবং আরো নানা উৎপীড়ন তাহাদের মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন আনিতে থাকে। যেহেতু মনের সহিত প্রজননের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক, সেই হেতু ধীরে ধীরে তাহাদের সুস্থ সন্তান জন্ম দিবার ক্ষমতা হ্রাস পাইয়াছে। ইহাকে ‘সহস্রাব্দীর অভিশাপ’ বলিয়া ডাঃ যুবনাশ্ব বর্ণনা করিয়াছেন।...

 

৩০২২ চান্দ্রবর্ষ , তৃতীয় মাস,  পঞ্চম দিবস, সান্ধ্য দিঙ্‌নাগ:

... ডাঃ যুবনাশ্বের মতবাদ লইয়া নানা বিতর্কের সৃষ্টি হইয়াছে। স্যমন্তক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারগণ এই তথ্যের তীব্র বিরোধিতা করিয়াছেন এবং ইহাকে আধুনিক চিন্তাধারার পরিপন্থী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহারা ডাঃ যুবনাশ্বকে ‘ভাববাদী’ আখ্যা দিয়াছেন এবং তাঁহার মতবাদের যাথার্থ্য প্রমাণের জন্য তাঁহাকে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য উপস্থাপন করিতে আহ্বান করিয়াছেন।...

 

৩০২৩ চান্দ্রবর্ষ , একাদশ মাস,  পঞ্চদশ দিবস, প্রভাতী সংশপ্তক :

...গতকল্য গভীর রাত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত এক বিশেষ অধিবেশনে ডাঃ যুবনাশ্ব তাঁহার মতবাদ উপস্থাপন করিয়াছেন। তিনি এই সমস্যাটিকে ‘লালন-জনিত সমস্যাবলী’ বা ‘Rearing Defect Complex,’ সংক্ষেপে R D C বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই অধিবেশনে ভাষণ প্রসঙ্গে তিনি বিশ্ববাসীর নিকট প্রস্তাব রাখেন যে সমস্যাটি যদিও আমাদের দেশেই এখনো সীমাবদ্ধ কিন্তু ইহার বিশ্বব্যাপী আকার লইবার সম্ভাবনা অনস্বীকার্য্য, ফলতঃ সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগ্রহণ সকল দেশেরই আশু কর্তব্য। ডাঃ যুবনাশ্বের মতবাদটি অতঃপর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।...

 

৩০২৩ চান্দ্রবর্ষ , দ্বিতীয় মাস,  সপ্তম দিবস, সান্ধ্য সংবর্ত :

... ডাঃ যুবনাশ্ব তাঁহার বিদেশ সফর শেষে আজ দ্বিপ্রহরে দেশে পদার্পণ করেন। উৎসুক সাংবাদিকদের তিনি জানান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের যৌথ প্রয়াসে রৈবতক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপিত হইতেছে। নূতন বিভাগটির নামকরণ হইয়াছে ‘অহল্যা গবেষণাগৃহ।’ R D C সংক্রান্ত গবেষণাই ইহার লক্ষ্য। ডাঃ যুবনাশ্ব আরো ঘোষণা করেন যে, তিনি আমৃত্যু সফলতার লক্ষ্যে সচেষ্ট থাকিবেন।...

 

৩০৪০ চান্দ্রবর্ষ , প্রথম মাস,  চতুর্থ  দিবস, প্রভাতী শঙ্খনাদ :

... নূতন বর্ষারম্ভে জনসাধারণের প্রতি ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন যে দেশ এখন গভীর সংকটে। অষ্টাদশ অনাধিক কোন সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান আমাদের দেশে নাই। অষ্টাদশ হইতে পঞ্চত্রিংশতি বৎসর পর্য্যন্ত রমণীগণ সুস্থ সন্তানের জন্মদানে অপারগ এবং তদূর্দ্ধ রমণীগণের প্রজননক্ষমতা প্রাকৃতিক নিয়মে সীমাবদ্ধ।

এই সংকট হইতে পরিত্রাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী নূতন বর্ষে ঘোষণা করিয়াছেন, যে দম্পতি দেশকে সুস্থ সন্তান উপহার দিতে সক্ষম হইবে তাহাদের বিশেষ সরকারী মর্য্যাদা দেওয়া হইবে। প্রতিটি সুস্থ সন্তানপিছু পিতামাতা একশত নিষ্ক পাইবেন।

প্রধানমন্ত্রী ইহাও ঘোষণা করিয়াছেন যে, অদ্য হইতে প্রতিটি কন্যাসন্তান পুত্রসন্তানের সমান মর্য্যাদা পাইবে। এই মর্মে একটি নূতন আইন প্রণয়ন করা হইতেছে। কোন রমণী যথোচিত মর্য্যাদা না পাইলে আদালতের দ্বারস্থ হইতে পারিবেন।

সরকারী উদ্যোগে প্রাণিকোষতত্ত্ব-সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিকগণ এবং প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণের যৌথ প্রয়াসে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হইতেছে।

এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হইল যাহাতে প্রতিটি দম্পতি এই দেশকে অবশ্যিক রূপে একটি কন্যাসন্তান উপহার দিতে সক্ষম হয়, সেই দিকে লক্ষ্য রাখা।

শিশুকন্যার পরিচর্য্যা এবং বয়সভেদে তাহাদের মানসিক গঠনের প্রতি যথোপযুক্ত দৃষ্টিপাত নিমিত্ত সরকার একটি পুস্তক প্রণয়নের কথাও চিন্তা করিতেছেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষামণ্ডলীর সহিত শীঘ্রই এই বিষয়ে তিনি আলোচনা করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন।...

 

৩০৪০ চান্দ্রবর্ষ , দশম মাস,  চতুর্দশ  দিবস, সান্ধ্য দিঙ্‌নাগ:

...গতকাল গভীর রাত্রে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া ডাঃ যুবনাশ্ব প্রাণত্যাগ করেন। তিনি তাঁহার মতবাদ R D Cর সমাধানকল্পে কঠোর গবেষণায় নিরত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিগত বিংশতি বৎসরের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি সফল হইতে পারেন নাই। তাহাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হইলে তাঁহার পাংশু ওষ্ঠ-দুইটি শেষ কয়টি শব্দ উচ্চারণ করে, ‘বড় পাপ হে!’...