কোজাগরী


#lakshmi #brata

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যেবা স্থাপি নিজ ঘরে

রাখিবে তন্ডুল তাহে এক মুঠা করে|

সঞ্চয়ের পন্থা উহা জানিবে নিশ্চয়

এর ফলে উপকার পাবে অসময়ে||

দুর্গাপুজোকে বলা হয় বাঙালির প্রাণের পুজো, প্রধান উৎসব| সে আজকে হতে পারে, এত corporate sponsorship আর রাজনৈতিক দীয়তাম্ ভ্জ্যতাম্-এর যুগে যে কোনো হুজুগে মেতে ওঠা শক্ত নয়, বিশেষ করে অর্থের যোগান যখন বিপুল| তবে দুর্গাপুজোর অর্থানুকুল্য গত চারশ বছর ধরেই বাঙালী সংস্কৃতির অংশ, সেই কংসনারায়ণ বা নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে| কলকাতায় দুর্গাপুজোর রমরমা বাবুয়ানির দেখনদারির সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত| ঠাকুর, শীল, দাঁ, দেব, মল্লিক — এ হেন টাকা ওড়ানোর খেলায় কেউই পেছনে পড়তে রাজি ছিলেন না| সে tradition সমানে চলছে| আজ বিভিন্ন বারোয়ারি পুজো বিচিত্র আলো আর মূর্তির গঠন সৌকুমার্য নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, দু’শ বছর আগে ব্রাহ্মণ-ভোজন, কবির লড়াই আর বাঈনাচ নিয়েও কলকাত্তাইয়া বাবুদের মধ্যে একই রকম প্রতিযোগিতা হত|

কলকাতায় অনেক পুজো হলেও, বাংলার গ্রামে সাধারাণতঃ দুর্গাপুজো হত একটাই, জমিদারের বাড়িতে| তাতে নেমন্তন্ন থাকত গ্রামের সকল প্রজার| বাবার সঙ্গে রাস্তায় পা দিয়ে অপু লুচি ভাজার অপূর্ব সুঘ্রাণে মোহিত হয়ে যেত| সর্বজয়া কি পুজো দেখতে যেত? না গেলেও ছাঁদা আসত ঘরে| মালসা ভর্তি বাসি লুচি, হালুয়া, মিষ্টি, পায়েস| পাঁচদিনের আড়ম্বর আর জাঁকজমকে কুলীন ব্রাহ্মণ থেকে জেলে-মালো-ডোম সকলেই মুগ্ধ হয়ে থাকত|

দুর্গাপুজো কিন্তু কোনোদিন বাঙালীর ঘরে ঘরে হয় না, আগেও হত না| সে হয় লক্ষ্মীপুজো বা লক্ষ্মীব্রত| বাংলাদেশে প্রচলিত ব্রত আছে অনেকই, তবে সবচেয়ে বেশি চলিত মা লক্ষ্মীর ব্রতকথা| এই মা লক্ষ্মী কিন্তু দুর্গা মায়ের মেয়ে নন, এমনকি ইনি সম্ভবত কোনো আর্য দেবীই নন| দুর্গাও কিন্তু পুরোপুরি আর্য নন, নিষাদ বা কোনো অরণ্যচারী অনার্য জাতির পূজিতা দেবী যাঁকে শক্তিস্বরূপিনী হিসেবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে| লক্ষ্মী হলেন ফসলের দেবতা, অন্নের দেবতা, প্রাচুর্যের দেবতা — তাই কৃষিজীবী বাঙালীর ঘরে ঘরে তাঁর পুজো| আশ্বিনের লক্ষ্মীপুজো সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, যদিও তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও অনেক গৃহস্থ বাড়িতেই বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো, পূর্ণিমার লক্ষ্মীপুজো ইত্যাদি যথেষ্ট নিয়মিতভাবে করা হত| এটা আশ্চর্য নয় কি, যেখানে পাঁচদিনের দুর্গাপুজো পনেরো দিন অবধি গড়াচ্ছে, কাশী বা লখ্‍‍নৌ থেকে বাঈজী আনানো হচ্ছে, সেখানেও বাড়ির লক্ষ্মীপুজোতে কোনো অনাচার বা হুল্লোড়ের প্রমাণ পাওয়া যায় না| তা কি লক্ষ্মীপুজো মেয়েলি ব্রতের মধ্যে পড়ে বলে? বাড়ির মেয়েদের হাতে তার সমস্ত দায়িত্ব, আর মেয়েরা যেহেতু রক্ষণশীল, গত হাজার বছরেও হয়ত লক্ষ্মীপুজোর মূল আচার-অনুষ্ঠানে বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি|

মেয়েদের বেশ কয়েকটি ব্রতকথা সংগ্রহ আমার কাছে রয়েছে| তার মধ্যে ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে প্রকাশিত অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সংকলিত রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা-সম্বলিত মেয়েলি ব্রত সম্ভবত সবচেয়ে পুরণো| বাংলা ১৩১৪ (১৯০৬-৭) সালে প্রকাশিত হচ্ছে শ্রী রামপ্রাণ গুপ্ত সংকলিত ব্রতমালা, ১৩১৫ সালে (১৯০৭-৮) শ্রী পরমেশপ্রসন্ন রায়ের মেয়েলি ব্রত ও কথা, ১৩১৯ (১৯১১-১২) সালে শ্রী কিরণবালা দাসী সংকলিত ব্রত-কথা| এছাড়াও রয়েছে শ্রীকালীকিশোর বিদ্যাবিনোদ সংকলিত ও শ্রী সুরেশ চৌধুরী কর্তৃক সংশোধিত, পরিবর্দ্ধিত ও পরিমার্জিত বৃহৎ বারমেসে মেয়েদের ব্রতকথা যেটির দ্বিতীয় প্রকাশ ১৩৯৩ সাল, প্রথম প্রকাশ অজানা| আর খুব সম্প্রতি হাতে এসেছে আশুতোষ মজুমদার প্রণীত দেব সাহিত্য কুটীরের মেয়েদের ব্রতকথা, যা নাকি পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষাবিভাগ কর্তৃক প্রাইজ, লাইব্রেরি ও জনশিক্ষার জন্য অনুমোদিত (২০১৮ পুনর্মুদ্রণ)|

অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ব্রত সংকলনে আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্মীব্রতর কোনো উল্লেখ নেই| অন্যান্য সংকলনে পাঁচ-পাঁচটি মাসে লক্ষ্মীব্রতর উল্লেখ রয়েছে এবং এগুলি সবই কোনো না কোনো ভাবে চাষের সময়ের সঙ্গে যুক্ত – ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ আর চৈত্র| প্রত্যেক লক্ষ্মীপুজোর ব্রতকথা আবার আলাদা| সব কথা আলোচনা করার সময় এখানে হবে না| তিনটে গল্প বলা যাক|

রামপ্রাণ গুপ্তের ব্রতমালায় আছে এক দুঃখী ব্রাহ্মণকুমারের কথা| একদিন একমুঠোও ভিক্ষে না পেয়ে তার চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছিল| এমন সময়ে লক্ষ্মীর পেঁচা সেখান দিয়ে উড়ে যেতে যেতে ব্রাহ্মণকুমারকে দেখতে পায়| তখন তাকে বলে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাতে লক্ষ্মীপুজো করতে| ব্রাহ্মণকুমার ব্রতের সব নিয়ম পালন করায় তার দালান-কোঠা ধন-দৌলত সবই হল| আশুতোষ মজুমদারের আর কালীকিশোর বিদ্যাবিনোদের মেয়েদের ব্রতকথার গল্প কিন্তু একদমই অন্যরকম| এ হল সেই ঊপনিষদের অলক্ষ্মীকে আশ্রয় দেওয়ায একে একে রাজ্যলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মীর ছেড়ে যাওযা| শেষে ধর্মও যখন ছেড়ে যেতে চাইলেন, রাজা আপত্তি করলেন, “আমি তো আমার প্রতিশ্রুতি পালন করেছি মাত্র| আপনি তো আমায় ছাড়তে পারেন না”| এই গল্পের সঙ্গে লক্ষ্মীপুজোর মাহাত্ম্য যুক্ত করা একটু শক্ত| সেটুকু করা হয়েছে রানীর মাধ্যমে, গরীব বন্য মেয়েদের দেখাদেখি রানীও লক্ষ্মীপুজো শুরু করায় মা লক্ষ্মীর কৃপায় আবার একে একে রাজার সমস্ত ঐশ্বর্য ফিরে এল| এই ব্রতকথাগুলির সঙ্গে কিন্তু পাঁচালির গল্পের সংযোগ দেখতে পাচ্ছি না| পাঁচালি শুরু হচ্ছে এই বলে

দোল-পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ|

মৃদু-মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস||

লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ|

করিছেন নানা কথা সুখে আলাপন||

পাঁচালীর গল্পে কিন্তু ধনবান বণিকের বিধবা স্ত্রী আর সাত ছেলে-বৌ-য়ের কথা রয়েছে| আর পরিষ্কার বলা হচ্ছে

গুরুবারে সন্ধ্যাকালে লয়ে বধূগণে

করিবে লক্ষ্মীর ব্রত হয়ে একমনে||

......

গুরুবারে যদি হয় পূর্ণিমা উদিত|

যে বা নারী অনাহারে করে এই ব্রত||

সকল বাসনা তার পূরণ হইবে|

পতি-পুত্র লয়ে সুখে বারমাস রবে||

মা লক্ষ্মী কৃষিজীবীদের দেবী হলেও ব্রতকথা আর পাঁচালিতে কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা অনাবশ্যক! লক্ষ্মীপুজোয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজনীয় নয়| অথচ একাধিক গল্প তাদেরই নিয়ে| কিরণবালা দেবীর চৈত্র মাসের লক্ষ্মীকথায় আছে, লক্ষ্মী বলছেন, “শঙ্খে আছি, চক্রে আছি, গদায় আছি, পদ্মে আছি, এক অংশ ব্রাহ্মণে আছি, এক অংশ রাজাতে আছি”| যা ছিল কৃষিকর্মের চক্রে আবর্তিত নরনারীর স্বাভাবিক আনন্দ-উৎসব, কালক্রমে তারও খানিক ব্রাহ্মণ্যকরণ ঘটল| অবনীন্দ্রনাথ বাংলার ব্রততে যেমন বলেছেন “মেয়েরা যেমনি নিজেদের মধ্যে ব্রত করেছে, অমনি মধু আর মিষ্টান্নের চারি দিকে ব্রাহ্মণ-মাছি আস্তে আস্তে এসেছে”|

কিন্তু ব্রতের আয়োজন আর কামনা সম্পূর্ণভাবেই রয়ে গেছে নারীকেন্দ্রিক| লক্ষ্মীপুজোর একটা প্রধান অংশ আলপনা|

নৃতত্ববিদ্‍রা মনে করেন আলপনার উদ্ভব আদিম কৌম সংস্কৃতির মধ্যে| এখন  যেমন যে কোনো রকম মঙ্গলাচরণে  আলপনা অপরিহার্য, বৈদিক যজ্ঞস্থলে কিন্তু আলপনার কোনো ভূমিকা ছিল না| আলপনার প্রধান উদ্দেশ্য হল ব্রতীর কামনাকে প্রকাশ করা| মা লক্ষ্মীর কাছে ব্রতীরা কি চাইবেন, সাংসারিক সমৃদ্ধি ছাড়া? অবনীন্দ্রনাথের বাংলার ব্রত (১৯১৯ সালে প্রকাশিত) সম্ভবত প্রথম প্রবন্ধ যেখানে ব্রতের আলপনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে| তিনি বলছেন, “ব্রতের ছড়াগুলির সঙ্গে ব্রতীর কামনার যে যোগ, ব্রতের আলপনাগুলির সঙ্গেও ঠিক সেই যোগটিই দেখা যায়|” কিন্তু যেমন-তেমন করে আলপনা দিয়ে কাজ সারা, অন্তত লক্ষ্মীপুজোয় চলে না| “ব্রতের মূলে কতখানি ধর্মপ্রেরণা, কতখানি বা সৃষ্টির বেদনা রয়েছে তা বোঝা শক্ত”|

আশ্বিনের লক্ষ্মীপুজোর প্রস্তুতি বাংলার গ্রামে শুরু হয়ে যেত বর্ষার শেষ থেকেই| নতুন করে লক্ষ্মী আঁকা হয় মধুখামে| মধুখাম হল বাড়ির প্রধান ভিটের ঘরের সর্বপ্রধান থাম, যা ঘরের চালের ওজনটা ধরে রাখে| গ্রামের যিনি ডাকসাইটে আঁকিয়ে তাঁর ডাক পড়ে| বেশ কয়েকদিন ধরে দুপুরবেলার অবসরে গল্পগাছার মধ্যে তিনমেটে রঙের কাজে লক্ষ্মীঠাকুরটি, তাঁর প্যাঁচাটি, গোলাপি পদ্ম, কোলের ঝাঁপি সব আঁকা হয় মধিখামের ওপরে| আর পুজোর দিনের প্রধান পর্ব হল আঙিনা জোড়া আলপনা| বাঁকা পদ্ম, অষ্টদল, শতদল, সহস্রদল পদ্ম, শঙ্খলতা, কলমীলতা, খুন্তিলতা, চিরুনিলতা, কলালতা, অনন্তনাগ, শেষে একসারি যাত্রাকলস – এই দিয়ে উঠোন ভরিয়ে তোলেন গৃহিণীরা| আর ছোটদের হাতে পিটুলিগোলা ধরিয়ে দিয়ে বলা হয় সব জায়গায় লক্ষ্মীর পাড়া, লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ এঁকে দিতে|

যে উৎসবে প্রতি বাড়ির সবাই যোগ দেয়, সেটাই তো প্রাণের উৎসব! লক্ষ্মী অচলা হয়ে ঘরে থাকুন, ধানে মরাই ভরে উঠুক, এইটুকুই চাহিদা| রূপ, জয়, যশ ইত্যাদি sublime চাহিদা থাকতে পারে পুরুষদের, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী অখিল জগতের প্রতি প্রসন্ন বা অপ্রসন্ন হতে পারেন, কিন্তু বাঙালী মেয়ে-বৌরা মা লক্ষ্মীর শরণ নিয়েই সন্তুষ্ট|

এই ব্রত যে রমণী করে একমনে|

লক্ষ্মীর কৃপায় তার বাড়ে ধনে-জনে||

অপুত্রের পুত্র হয় নির্ধনের ধন|

ইহলোকে সুখ, অন্তে বৈকুন্ঠে গমন||