এখন বেড়ানো মানে হোটেলে গিয়ে ওঠা, কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় ছুটিছাটায় আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার. আদর আপ্যায়নে নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হতো. ঠাকুমা আর কাকুর সঙ্গে দুর্গাপুরে জ্যেঠুর বাড়ি গেছি. উত্তর কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে কোয়ার্টার এর বিস্তীর্ণ পরিসরে দৌড়োদৌড়ি করে ভালোই সময় কাটতো. ছোটোপিসির বাড়ি যেতাম সপরিবার সীতারামপুর. পিসতুতো দিদিরা আপন দিদির চেয়ে কিছু কম নয়, হৈচৈ আড্ডা তো ছিলই, আর ছিল বিশাল খাট. তাতে প্রচুর বালিশ, চাদর. ওখানে হেলান দিয়ে বসে গল্পের বই পড়ার আলাদা সুখ. গল্পের বই ছিল বটে বড়পিসির বালিগঞ্জের বাড়িতে. সেখানেও যেতাম ঠাম্মার সঙ্গে. সে এক প্রকান্ড বাড়ি, প্রচুর ঘর, তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ছাদের আলমারিতে বিপুল বই এর সম্ভার, ইংরেজি, বাংলা দুই ভাষার সব বিখ্যাত বই.
বড়ো হয়ে কাজের সূত্রে দিল্লি গিয়ে থেকেছি মাসতুতো বোন রুমুর কাছে. গরমে যাতে কষ্ট না হয়, তাই আমি যাওয়ার আগে থেকে ঘর ঠান্ডা করে রাখতো. মেদিনীপুর পোস্টিং এর পুরো সময়টাই তো কাটালাম বোনের খড়্গপুর এর কোয়ার্টারে. সেখানে ডান কাত হয়ে শুয়ে ফোন করতাম, উপুড় হয়ে শুয়ে পরের দিনের পড়া করতাম, আর বাঁ কাত হয়ে শুয়ে বোনের বের করে দেওয়া শাড়ি গয়না থেকে পছন্দ করতাম কোনটা পরে পরের দিন যাবো.
বিদেশে গিয়ে থেকেছি সিদ্ধার্থ র বন্ধুদের কাছে. পরে তারা আমারও বন্ধু হয়ে গেছে. গৌতম এক আশ্চর্য ছেলে যে বাড়িতে মৌমাছি পোষে. আলো জ্বলা টুপি দিয়েছিলো বুবকাকে, সেটা পরে মৌমাছি দেখতে যেতে হতো. আর দেবাংশুর কথা কি বলবো. বুবকা যখন ওদের কাছাকাছি ইউনিভার্সিটি তে পড়তে গেলো, ওর কি কি দরকার হতে পারে ভেবে কি যে কিনে রাখে নি! সত্যি বলতে আমার যাবার কোনো দরকারই ছিল না. দিব্যি খেয়ে, বেরিয়ে, ঘুমিয়ে পনেরো দিনের ছুটি কাটিয়ে ফিরলাম.
দেশে গিয়ে থেকেছি সহপাঠী বন্ধু তাপসের কাছে. সে বছর বেনারস থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে. তাপস বেনারসে পোস্টেড্. অতএব চলো যাই. বাবা বিশ্বনাথ দর্শন ও হবে. গঙ্গা আরতি, বেনারস ভ্রমণ সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো.
তাপসের বৌ কাকলি আমাদের পূর্বপরিচিত. ওদের ধানবাদ এর বাড়িতেও গেছি. কাকলির বড়দা, নবারুণদা, আর. জি. করে আমাদের সিনিয়র. ছোড়দা নুটু আমাদের বন্ধু.
অতিথিবৎসল আত্মীয় বন্ধুদের দারুণ আতিথ্য সত্ত্বেও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে নবারুণদার বাড়ির গল্পটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়. সেটাই বলি এখন.
কি কারণে যেন ওরা ধানবাদ যেতে বলেছিলো এবং আমরা মানে আমি আর সিদ্ধার্থ রাজিও হয়ে গিয়েছিলাম. স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে ওদের বাড়ি যাচ্ছি, দেখি সাইকেল নিয়ে নুটু আসছে. ভাবলাম আমাদের নিয়ে যেতে আসছে. ওমা, বলে কি, পাশের বাড়িতে চাবি দেওয়া আছে, তালা খুলে বস, আসছি. কারো বাড়িতে প্রথমবার যাচ্ছি, তালা খুলে ঢুকছি, ভাবা যায়!
আচ্ছা, পাশের বাড়ির লোক তো আমাদের চেনে না. যে কেউ গিয়ে চাবি চাইলে দিয়ে দেবে? আমি সিদ্ধার্থ কে জিজ্ঞেস করলাম. ও বললো লোকাল লোকদের তো চেনে. আর কলকাতার লোক, সুটকেস নিয়ে আসছে, ও দেখলেই বোঝা যায়. এই গরমে, দুপুর বেলায় সবাই দরজা জানলা বন্ধ করে বসে আছে, কে জানে কিভাবে চাবি পাবো! ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে রিকশা থেকে নামতেই উল্টো দিকের বাড়ি থেকে একজন বেরিয়ে এসে হাতে চাবি ধরিয়ে দিলো. নামটাও জানতে চাইলো না.
ঘরে ঢুকে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ. ঘরের মাঝ বরাবর একটা ফাঁসির দড়ির মতো দড়ি ঝুলছে, পরে শুনলাম ওটা সারভিক্যাল স্পন্ডাইলোসিস এর ট্রাক্শন দেবার নবারুণদা আবিষ্কৃত যন্ত্র. অন্য ঘরে খাট, চেয়ার সর্বত্র জামা কাপড়, এটা, সেটা ছড়ানো. বসবো কোথায়! আমি সব একদিকে ঠেলে একটু জায়গা করলাম. সিদ্ধার্থ র এসব খুব অপছন্দ. ওর জিনিস ও নিজে গুছিয়ে রাখে. অন্যের জিনিসে মোটে হাত দেয় না. যাই হোক, কিছুক্ষন বাদে নুটু এলো, নবারুণদা ও. একটু বিশ্রাম নেবার পর বললো, চা খাবি তো ? অনেক ক্ষণ থেকেই মনটা চা চা করছে. বললুম হ্যাঁ.
রান্না ঘরে গিয়ে নুটু র আর্তনাদ, বেড়াল আবার দুধ খেয়ে গেছে. জানলা খোলা ছিল. জিজ্ঞেস করলো লিকার চা খাবো কি না. সিদ্ধার্থ না বললেও আমি বললাম খাবো. চিনি আর চা পাতা দিয়ে ভেজানোর পর ছাঁকনি খুঁজে পাওয়া গেলো না. বললো, একটু পরে চা পাতা থিতিয়ে নিচে পরে যাবে, ওপর থেকে খাস. আর একটু চা পাতা মুখে গেলেই বা কি!
নবারুণদা বললো বেড়াল টা খুব ঝামেলা করছে. কিন্তু বিষ দিয়ে মারতে কেমন যেন লাগে. যা করছে, পেটের দায়েই তো করছে. সে তো সত্যি কথাই.
আচ্ছা, তোরা রাতে কি খাবি? খিচুড়ি খাবি? সোমা, রাঁধতে পারবি?
সর্বনাশ! আমি তো মোটেই রান্নাবান্না করি না. খুব মাঝেসাঝে. খিচুড়ি যদিও পারি.
জিনিসপত্র সব আছে তো? পাকা রাঁধুনি র মতো প্রশ্ন করি. দুই ভাই মিলে সে সব অবশ্য জোগাড় দিলো. তারপর একটা বিরাট প্রেসার কুকার এনে হাজির করলো. এটাতেই রাঁধতে হবে.
-ও বাবা, তোমরা কত খাও!
-আরে, চার জনের জন্য এটা লাগবে.
আমি বললাম, রান্নার পর গ্যাস থেকে ওটা আমি নামাতে পারবো না. ভারী হয়ে যাবে.
-সে আমরা আছি তো.
তারপর খিচুড়ি রাঁধলাম, আর ডিম্ ভাজা, পাঁপড় ভাজা, বেগুন ভাজা.
খেয়ে উঠে বললাম, কাল একটু শ্যাম্পু করবো. আজ অবেলায় আর করি নি. ট্রেন জার্নি করে এসেছি তো.
বেশ তো. তাতে আর অসুবিধা কি, দাদাদের অভয়বাণী.
পরের দিন দেখি নুটু ঘাড়ে করে একটা পাম্প নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে.
-এটা কি, কেনো?
-পাশের বাড়ি থেকে খুলে আনলাম. তুই শ্যাম্পু করবি বলে. আমাদেরটা বিগড়েছে.
সিদ্ধার্থ চেঁচামিচি জুড়ে দিলো, এসবের কি দরকার ছিল. একদিন শ্যাম্পু না করলে কি হয়. অহেতুক মানুষকে কষ্ট দেওয়া. আমি যথেষ্ট বিব্রত বোধ করছিলাম. কিন্তু চেঁচামিচি তে রেগে গিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম.
তখন নুটু “রাগিলে লাল ছড়ি, হাসিলে গোলাপ কুঁড়ি” জাতীয় উদ্ভট গান গেয়ে আমাকে হাসিয়ে ছাড়লো. তারপর শ্যাম্পু করে তাপসের বাড়ির দিকে যাত্রা.
এখন অবশ্য দুই ভাই বিয়ে করে ঘোর সংসারী. ঘরে লক্ষী শ্রী বিদ্যমান. ফলে এই আতিথ্যের অভিজ্ঞতা একান্তভাবেই আমার.
মতামত
কতো সহজে আমাদের চেনা পরিচিত ovignyata, গুলো বলে যাস,বড় ভালো লাগে।
Susmita Siddhanta
08-05-2023 10:28:10