পুজোর বেড়ানো
#travel #pujo
পুজোতে বেড়াতে যাওয়া একটা বাৎসরিক রিচুয়ালের মতই ছিল| বেশিরভাগ বছরই এরকম হত যে বন্ধুরা স্কুলের ছুটি খোলার পরে যখন পাড়ার পুজোর গল্প করছে, কে কটা ঠাকুর দেখেছে তার হিসেব করছে, আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি, কারণ সে বছর হয়ত আমি মাদ্রাজে একটাই তামিল দুর্গা প্রতিমা দেখেছি| এ আমি ১৯৭০-এর দশকের কথা বলছি — তখনও রাত জেগে সারা কলকাতা চষে ফেলার কালচার তৈরী হয়নি|
তখন বেড়াতে যাওয়াটা বেশ একটা বড়সড় ব্যাপার ছিল| হোল্ডল — Hold-all — নামেও যেমন, কাজেও তেমন| আমাদেরটা ছিল সবুজ ক্যাম্বিসের| চাদর, বালিশ, কম্বল, কম্বলের ওয়াড়, গামছা, তোয়ালে ইত্যাদি হরেক কিসিমের চীজ তাতে ঢোকানো হত| সব পেতে পেতে সুন্দর করে পুরতে হবে — এটা ছিল বাবার দায়িত্ব| খুঁতখুঁতে মানুষ, অন্য কারোরটা পছন্দ হত না| বালতি আর মগ সঙ্গে যেত| এমনকি একটা প্রেসার কুকারও| বড় চামড়ার সুটকেশ বা লোহার ট্রাঙ্ক, স্টেনলেস স্টীলের থালা, বাটি, গেলাস| যাতায়াত? অবশ্যই ট্রেনের থ্রি-টেয়ার, থার্ডক্লাস| গরম, কয়লার গুঁড়ো, নোংরা — কোনো কিছুতেই বিশেষ অসুবিধে হত না| ছোট ছিলাম বলে, আর ওতেই অভ্যস্ত ছিলাম বলেও| অন্য রকম কিছু যে হতে পারে তা তো ধারনাতেই আসত না| ট্রেনে দু-রাত কাটানোতে বিশেষ সমস্যা ছিল না, কয়েকটা পুজো সংখ্যার ব্যবস্থা রাখতে হত শুধু| তখন থার্ডক্লাসের বাথরুমেও স্নান করা যেত, বালতি-মগ সে কারণেই সঙ্গে থাকত| আর লম্বা পথে বাথরুমে জল ফুরিয়ে যেত অনেক সময়ে, সব স্টেশনে ট্রেনের কামরায় জল ভরার বন্দোবস্ত থাকত না| তখন ঐ বালতি কাজে দিত|
ঐ দু-রাত ট্রেনে একসঙ্গে কাটানোর সুবাদে কত লোকের সঙ্গে ভাব হযে যেত| একবার আমাদের ঠিক সামনের তিনটে সীটে আমার কাছাকাছি বয়সের তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল| তারা দেখলাম সিগারেটের প্যাকেটের মতন একটা প্যাকেট থেকে সাদা লম্বা সিগারেটের মতই কি একটা মুখে দিয়েছে| আমায় বলল, “খাবি? সিগারেট”| আমি তো ক্যাবলা, ঘাড় নেড়ে বললাম, “না”| তখন তাদের মধ্যে যে বড়, সে বোঝাল, “দূর বোকা, এটা পেপারমেন্ট| মুখে নিয়ে চুষতে হয়”| আমি সাবধানে একটা মুখে দিলাম| বাঃ, দিব্যি তো! বাক্সগুলো নীল-সাদা বা লাল-সাদা ডোরাকাটা| ঐ একবারই খেয়েছিলাম মনে হয়, ওদের কল্যাণে; আর দেখতেও পাইনি, খাইওনি|
আর একবার হাওড়া থেকে কোথাও একটা যাচ্ছি, উল্টোদিকে এক দেহাতী স্বামী-স্ত্রী| ট্রেন ঠিক চলতে শুরু করেছে, একটি ছেলে চালকুমড়োর মিঠাইয়ের একটা প্রকান্ড প্যাকেট জানলা দিয়ে ঠেলে গুঁজে ঢুকিয়ে দিল| প্যাকেট ছিঁড়ল, আদ্ধেক কামরার মেঝেতে পড়ল, আমাদের সুটকেশ-হোল্ডলের ওপর গুঁড়ো ছড়াল, ওরা আবার সেগুলো সযত্নে মেঝে থেকে তুলতে লাগল| মা তো রেগে কাঁই| যত তাদের বকাবকি করে, তারা ততই সেই মিঠাই আমাদের খেতে দিতে চায় – সেই মেঝে থেকে কুড়নো মিঠাই! সেই মহিলা তো বুঝতেই পারছে না যে রাগারাগিটা হচ্ছে সব নোংরা হয়ে গেছে বলে, আমাদের সঙ্গে মিঠাই ভাগাভাগি না করার জন্য নয়|
আমার ছোটবেলার বেড়ানোর গপ্পো বলাই হবে না, বটুদার কথা না বললে| কত জায়গাতেই যে তিনি আমাদের সঙ্গে গেছেন| বটুদা আমার বাবা-মায়ের বটুদা, আবার আমারও বটুদা| বাবারা যখন সালকের উত্তম ঘোষ লেনের ভাড়াবাড়িতে থাকত, তখনকার আলাপী| কেমন করে যেন আমাদের আত্মীয়ের বাড়া বন্ধু হয়ে গেছিলেন| ভাষা জানতেন নিদেন পক্ষে গোটা পাঁচ-ছয় — বাংলা ছাড়াও| চোস্ত ইংরিজি, চোস্ত হিন্দি, উড়িয়া বলতেন মাতৃভাষার মত, এমনকি তামিল না তেলেগুও জানতেন খানিকটা, ভাঙা ভাঙা কাজ চালিয়ে নেবার মত| সারা বছর ছুটির তোয়াক্কা না করে বেড়িয়ে বেড়াতেন| মা ঠাট্টা করে বলত, “রিটায়ার করে বটুদার মাইনে বেড়ে গেছে| চাকরি করার সময়ে তো কোনো মাসেই পুরো মাইনে পেতেন না| এখন তো পেনশন আর কাটা যাবে না”! বটুদা হয়ত আমাদের বাড়ি এসে শুনলেন আমরা অমুক দিন অমুক জায়গায় যাব| বটুদা টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লেন| অনায়াসে দরজার সামনে একটা চাদর বিছিয়ে বসে রইলেন আর সব্বার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললেন| ছোটখাট চেহারা, দাড়ি-গোঁফ, আমার ছোটবেলায় মাথায় একটা ঝুঁটিও দেখেছি| একসময়ে কেবল গেরুয়া লুঙ্গি আর গেরুয়া পাঞ্জাবিই পড়তেন, পরে সাদা ধুতি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি| সন্ন্যাস নেননি কিন্তু, গুরুমন্ত্র নিয়েছিলেন| আমার মা-বাবার তো ধর্মের আচারে কোনো বিশ্বাস ছিল না| বোধহয় হরিদ্বারে পান্ডারা মহা ঝঞ্ঝাট লাগিয়েছে যে তাদের সঙ্গে ছাড়া কোন মন্দির না কোথায় কিছুতেই ঢুকতে দেবে না| মা শেষে বিরক্ত হয়ে বটুদাকে দেখিয়ে বলে উঠল, “দেখছ না আমাদের সঙ্গে স্বামীজী রয়েছেন”| হরিদ্বার-ঋষিকেশের আখড়া আর এস্প্ল্যানেডের গলিতে পন্ডিত সাহেব, হিপি মেম, ফিনল্যান্ড থেকে আসা আর্টিস্ট, কফিহাউসের আঁতেল, বটুদা সবার বন্ধু, সবার সঙ্গে সমান আলাপ| ইনারি ক্রোন, ফিনিশ আর্টিস্ট, শাড়ি পরা শিখতে চাওয়ায়, বটুদা তাঁকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এলেন, মা’র কাছে|
অসাধারন ভালো ছবি তুলতেন বটুদা| মেট্রো গলি এবং ঐ তল্লাট ছিল বটুদার চারণভূমি| দামী ক্যামেরা কিনে ফেলতেন কোনো কার্পণ্য না করে| Nikon, Minolta, Asahi-Pentax নানান ক্যামেরা দেখেছি বটুদার কাছে, নানান লেন্স| কিছু সাহেবদের কাছ থেকেও কিনতেন, সরাসরি| সে তো ছিল সাদা-কালো ছবির যুগ| আজ ষাট বছর পরেও বটুদার তোলা ছবিগুলো আধুনিক অনেক ফোটোগ্রাফারের ঈর্ষার কারণ হতে পারে|
এ হেন বটুদার সঙ্গে একবার গেলাম চক্রধরপুর| হোটেল বুকিং সম্ভবত ছিল না, ১৯৭০-এ কি কলকাতায় বসে চক্রধরপুরের হোটেল বুকিং করা যেত? জানি না| চক্রধরপুরে কি তখন হোটেল ছিল? তাও জানি না| আমরা চারজনে রইলাম একটা একতলা বাড়ির ছাদের ঘরে| ঐ একটাই ঘর ছাদের ওপর, বেশ বড় খোলা ছাদ| বাথরুম হয়ত ছিল একটা, মনে নেই| ছাদ থেকে আদিগন্তবিস্তৃত ছোটোনাগপুর মালভূমি, শুকনো জমি, দূরে ছায়া-ছায়া পাহাড়| পঞ্চাশ বছর পরেও আমি সেই মেয়েটাকে সেই ছাদে বেশ পরিষ্কার দেখতে পাই, মহানন্দে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে| সম্ভবত মা রাঁধত, বাসন মাজত — হ্যাঁ, বেড়াতে গিয়েও| আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য না কাজের সুবিধের জন্য তা নিয়ে মাথা ঘামানো তখন তো আমার কাজ ছিল না| এখন ভাবি বেড়াতে কতটা ভালোবাসলে এত অসুবিধে সহ্য করে বা এত পরিশ্রম করেও বেড়ানো যায়| একটা সাতশ স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটে ছ-জনের সংসার থেকে ঐটাই বোধহয় ছিল মুক্তি|
চক্রধরপুরে কয়েক দিন থেকে আমরা গেলাম সিনিতে| অনায়াসে চড়াও হলাম বটুদারই পরিচিত এক প্রবাসী বাঙালী পরিবারের বাড়ি| তাঁরা নাকি বটুদাকে বলেছিলেন, “এদিকে আসলে আমাদের ওখানে নিশ্চয় উঠবেন”| অতএব সবান্ধব উপস্থিতি| তাঁরাও মহাখুশী| ভদ্রমহিলার চেহারা একটু একটু মনে পড়ে – ছোটখাট নরম চেহারা| বোধ করি তিনটি ছেলেমেয়ে, আমার চেয়ে একটু বড়| তারা আমাকে নিয়ে মহোৎসাহে পাড়া বেড়াতে বেরল|
যে কদিন ছিলাম, দু-তিন দিনের বেশি নয়, রোজই তাঁদের এক প্রতিবেশী আসতেন বেহালা বাজিয়ে শোনাতে| ভালো বাজাতেন বা মন্দ – সে বোঝার ক্ষমতা তখন ছিল না (এখনও আছে কি?)| কিন্তু চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছেন, সে ছবি খুব স্পষ্ট মনে আছে| বাজাবার সময় মুখটা হাঁ হয়ে যেত, নাল গড়াত| তাই কাঁধে একটা তোয়ালে রাখতেন|
বেড়ানো কত বদলে গেছে এখন তাই ভাবছিলাম| আগেরটাই ভালো ছিল, এখনকারটাই খারাপ, এরকম মনে করার কারণ দেখি না যদিও| আগে লোকের ছিল উঠল বাই, তো কটক যাই| এখন শখ হলে একা একা টুক করে প্যারিস বেড়িয়ে আসাও অসম্ভব নয়! আসল কথা হল, আনন্দ| তার পরিমানে যেন ঘাটতি না পড়ে|
Reply here
Comments