বসুধৈব কুটুম্বকম


#

নিমন্ত্রণ রক্ষা করার ব্যাপারে আমি যতটা আগ্রহী, সিদ্ধার্থর তাতে ততটাই অনীহা। নিমন্ত্রণে গেলে যেসব শাড়ী গয়না আলমারীর জেলখানায় কয়েদ, সেগুলো একটু আলোর মুখ দেখে। তাছাড়া কতজনের সঙ্গে দেখা হয়। কত খবর পাওয়া যায়। বহুদিন পর্যন্ত শ্বশুর বাড়ীর তরফের নিমন্ত্রণে শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে এবং বাপের বাড়ীর তরফের নিমন্ত্রণে বাবা মার সঙ্গে গেছি, সিদ্ধার্থর পরোয়া না করে। মুশকিল হল যখন তাঁরা নানা কারণে অপারগ হলেন। আমার প্রধান সমস্যা, আমার আত্মীয় স্বজনের পরিসর এত বিস্তৃত এবং এত দীর্ঘ ব্যবধানে একেকজনের সঙ্গে দেখা হয়, যে আমি মনে করতেই পারি না, সে কে, তার নাম কি, বা তাকে কি বলে সম্বোধন করা উচিত। অথচ তারা আমাকে ঠিকই চিনে ফেলে। যদি বলে, আরে বৌদি, তাহলে অবশ্য বুঝে যাই সম্পর্কটা কি। কিন্তু নাম ধরে ডাকলে বেজায় মুশকিল। তাই একা নিমন্ত্রণ বাড়ীতে যেতে খুব অস্বস্তি হয়। একবার একজনকে বলেছিলাম ওমা চিনতেই পারি নি, কত বড় হয়ে গেছো। পরে শাশুড়ির বকুনি খাই। তুই ওকে বিয়ের পর চিনেছিস ও কথাটা বললি কোন আক্কেলে!
একবার সিদ্ধার্থর এক মাসতুতো বোনের বিয়ে দক্ষিণ কলকাতায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ও দক্ষিণ কলকাতার অফিস থেকে আমায় নিতে উত্তর কলকাতায় আসবে না। সেই দক্ষিণেই যখন যেতে হবে। তাই হুকুম হল, তুমি একা চলে এসো, একসঙ্গে ফিরব।
সেজেগুজে উপহার বগলে চললাম নিমন্ত্রণ বাড়ীর দিকে। ঠিক রাস্তায় ঠিক নম্বরে পৌঁছে গেলাম অনায়াসে। এই তো আলো জ্বলা বিয়েবাড়ী। সোজা ঢুকে গেলাম, কই কেউ তো আপ্যায়ন করছে না, আমিও কাউকে চিনতে পারছি না, তখন মুঠোফোন ছিল না। বউকে অবশ্য ভালোই চিনি। যাই উপহারটা হস্তান্তরিত করি। এমন সময়ে শুনি, “ম্যাডাম, আপনি”! ম্যাডাম বলে এখানে কে ডাকে। দেখি ভীষণ পরিচিত মুখ, কিন্তু কে, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। বাচ্চা ছেলে, তুমি বলাই যায়। তাই বলি, “তুমি এখানে?”

“এখানে ছোড়দার ভাই ক্যাটারিং করছে। আমি পার্ট টাইম করছি”। ও হো, এ তো চঞ্চল, কলেজ ক্যান্টিনের ছেলে। এই পোশাকে চিনতে পারি নি।
“কি নেবেন ম্যাডাম, কফি না কোল্ড ড্রিংক”?

“দাঁড়াও, বউএর সঙ্গে কথা বলে আসি। কোনদিকে বলোতো?”

নির্দেশমতো গিয়ে দেখি সিংহাসনাসীনা মোটেই আমাদের ঝুমু নয়। ভুল বাড়ীতে ঢুকে পড়েছি। মানে মানে কেটে পড়তে হবে।  এই জন্য কোন চেনা লোক দেখছি না। চুপি চুপি পালাচ্ছি, এমন সময়ে আবার ডাক, “ম্যাডাম”। হাতে কোল্ড ড্রিংক্সের গ্লাস নিয়ে চঞ্চল হাজির। মহা মুশকিল, বাধ্য হয়ে বললাম, “শোনো, ভুল বাড়ি এসে পড়েছি। কেউ যেন না জানে। আমি পালাচ্ছি”।

এমন সময় হঠাৎই হাজির এক সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক, “আরে, তাতে কি হয়েছে, অনেকেই এই ভুল করেছে। একই বাড়ীর দুটো অংশে দুটো বিয়ে হচ্ছে তো। দেখবেন, North Gate আর West Gate বলা আছে ঠিকানায়। তাছাড়া দরজায় ব্রাইড আর গ্রুম এর নাম ও লেখা আছে। অতকিছু আমি থোড়াই খেয়াল করে থাকি। হেঁ হেঁ করে পালাচ্ছি, উনি বললেন, “একটু সরবৎ খেয়ে গেলে কিছু হতো না। বেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে… আচ্ছা, থাক, চঞ্চল তো দেখছি আপনাকে চেনে। পৌঁছে দিয়ে আসুক না হয়”। “না, না আমি যেতে পারব। অনেক ধন্যবাদ”। বলে দৌড় লাগাই। মানে পালিয়ে বাঁচি। নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছতে এরপর আর অসুবিধা হয় নি। আমিও অনেককে চিনেছি। ওরাও আমাকে। ভালোই খাতির যত্ন, খাওয়া দাওয়া হল। বেরিয়ে দেখি সেই ভদ্রলোক। সিদ্ধার্থর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। অবশ্য ওঁনার পরিচয় জানি না, তাই পরিচয়  পর্ব একতরফাই হলো। ভদ্রলোক বললেন, “এই যে পাশেই আমার বাড়ী। আসবেন একদিন। আজ তো জলস্পর্শ না করেই চলে গেলেন”। ভুল বাড়ীতে ঢোকার জন্য জীবনে এই প্রথম নিমন্ত্রণ পেয়ে আমি বিশেষ আহ্লাদিত। যেহেতু সিদ্ধার্থকে গোটা গল্প বলার সময় পাইনি, সে বেচারা আগাগোড়া কিছুই বুঝল না। ভাবল আমার কোন পরিচিত বুঝি! পরিচিত তো বটেই। আমরা তো বিশ্বাস করি, বসুধৈব কুটম্বকম।