সত্যবতী থেকে সুবর্ণলতা


#motherdaughter

মাতা - কন্যা পরম্পরা

আট বছরের সত্যবতী — গৌরীদত্তা সত্যবতী| নাকে নোলক, কানে মাকড়ি, পায়ে মল, বৃন্দাবনী ছাপের আট-হাতি শাড়ি পরা সত্যবতী| অপ্রতিহত প্রভাব তার পাড়ার ছেলেমেয়ের ওপর| তাদের দলনেত্রী হয়ে ঠাকুমা, পিসঠাকুমা, খুড়ী-জেঠীদের শাসন উপেক্ষা সে যথেচ্ছ দস্যিপনা করে বেড়ায়| কেউই তাকে এঁটে উঠতে পারে না| কেননা তার দুরন্তপনা ও জোর গলায় জাহির করা অজস্র মতামতের পেছনে রয়েছে তার বাবা রামকালী কবিরাজের কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়| রামকালী কবিরাজ নামকরা বৈদ্য, দিগ্বিগিকে তাঁর খ্যাতি| তৎকালীন প্রচলিত বর্ণাশ্রম ধর্ম, পূজার্চনার নিয়ম-কানুন মানলেও, লঘুপাপে গুরুদন্ড এবং চন্ডীমন্ডপ রাজনীতি ছিল তাঁর ঘোর অপছন্দ|  কিছু স্বাধীন মতামত তাঁর ছিল, কিন্তু নব্য শিক্ষিত বা ইংরেজি শিক্ষিত বলতে যা বোঝায় তা তিনি কখনোই ছিলেন না|

সত্যবতীর স্বামী নবকুমার, বাপের একমাত্র সন্তান, মায়ের আদরে লালিত, সুপুরুষ, শিক্ষিত, এমনকি কিছু ইংরেজিও পড়েছে| বাঙালী ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায় — ব্যক্তিত্বহীন, ভালোমানুষ, শক্তের ভক্ত| সত্যবতীর জেদের কাছে হার মেনে নবকুমার গ্রামের বদ্ধ ডোবা থেকে নাও ভাসাতে এল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশের কলকাতায় — রামকৃষ্ণের কলকাতা, কেশব সেনের কলকাতা, যেখানে এমনকি মেয়েরাও ইশকুল যেতে পারে| আবার অতি রক্ষণশীল কলকাতা, যেখানে পয়সার গরমে একজন আর একজনকে কিনে নিতে চায়, যেখানে লেখাপড়া জানা মেয়েমানুষ হাসির খোরাক হয়, যেখানে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের অপরাধে অনায়াসেই চির উপকারী শ্রদ্ধার্হ শিক্ষককে ত্যাগ করা যায়|

সত্যবতী বাংলা অক্ষর চিনেছিল নিজে নিজেই| তারপর বাবার কাছে সে নিয়মিত পড়তে বসত, যতদিন না ঘরবসত করতে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি বারুইপুরে| সেখানেও সে যতদূর সম্ভব বই পড়ার চর্চা রেখেছিল| বাবাকে চিঠি লিখত সত্যবতী, এমনকি সর্বমঙ্গলাতলায় বয়স্কা মহিলাদের একটু একটু পড়তেও শেখাত সে — দুপুরবেলা, স্বামীর অগোচরে | সংসারে সত্যবতীর মান্যতা এতটাই ছিল যে, নবকুমারের প্রাথমিক আপত্তি কাটিয়ে সে এক জ্ঞাতি ভাজের দ্বিতীয় বিয়ের সন্তান সুহাসিনীকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে বেথুন স্কুলে পাঠিয়ে মানুষ করে তুলছিল| রামকালী যথেষ্ট প্রাচীনপন্থী হওয়া সত্বেও সুহাসিনীকে আশীর্বাদ করেছিলেন মন খুলেই|

সত্যবতীর দুই ছেলের চেয়ে অনেক ছোট তার একমাত্র কন্যা, বুড়ো বয়সের আহ্লাদী, সুবর্ণলতা| তাকেও সত্যবতী বেথুন স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল, অনেক আশা ছিল সুবর্ণ লেখাপড়া শিখে একটা মানুষের মত মানুষ হবে| কিন্তু মাত্র নয় বছর বয়সে সুবর্ণর ঠাকুরমা আর বাবা ষড়যন্ত্র করে তার বিয়ে দিয়ে দিল সত্যবতীর অজান্তে| স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় ঘর ছাড়ল সত্যবতী| তখন রামকালী কাশীতে| সত্যবতীর বাকি জীবনটা সেখানেই কাটে| একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, সেখানে পড়িযে সে নিজের গ্রাসাচ্ছাদনটুকু জোগাড় করে নিত| স্বামী পুত্রের বহু মিনতিতেও সংসারে আর ফিরে আসেনি|

          সুবর্ণলতার জীবন শুরু হল কলকাতা শহরের অতি রক্ষণশীল নিম্নবিত্ত রুচিবোধহীন এক যৌথ পরিবারের মেজবৌ হয়ে| সেখানে মেয়েদের লিখতে পড়তে জানা, নিজস্ব চিন্তাভাবনার ক্ষমতা থাকা, নিজস্ব মত প্রকাশ দূরে থাকুক, বৌ-মানুষের গলার স্বর শুনতে পাওয়াই ছিল অপরাধ| দৈহিক নিপীড়ন সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার| তবু সুবর্ণলতা যথাসাধ্য লড়াই করেছে সারা জীবন, বই পড়েছে বিভিন্ন সূত্রে ধার করে, ছেলেদের মানুষ করার চেষ্টা করেছে, নিজের বাড়ি করে উঠে গেছে যৌথ সংসার ছেড়ে, ছোট দুই মেয়েকে স্কুলে পড়ানোরও চেষ্টা করেছে| পরিবর্তে পেয়েছে অপমান, দুর্বিষহ যন্ত্রণা, বঞ্চনা — স্বামীর কাছ থেকে, শাশুড়ির কাছ থেকে, শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলেদের কাছ থেকেও| যখনই ভব্যতা, সভ্যতা বা পরিচ্ছন্নতার সংস্কৃতি সুবর্ণ তার সেই মান্ধাতার আমলের মানসিকতা-সম্পন্ন শ্বশুরকুলে প্রবর্তন করতে চেয়েছে, অবজ্ঞা, উপহাস, ব্যঙ্গ, পীড়ন ও নিষেধের উজান ঠেলতে ঠেলতে নিজের অন্তরের দাহয় সে নিজেই নিঃশেষে ভষ্ম হয়ে গেছে|

যদিও মা কে সুবর্ণ শেষ দেখেছে সেই বাসি বিয়ের দিনে, সত্যবতী ছিল তার জীবনের আকাশে সুদূর এক ধ্রুবতারার মত| যেমন ছিলেন রামকালী, সত্যবতীর জীবনে| রামকালীর কাছে সত্যবতী চিঠি লিখতে পারত, দুর্দমনীয় বাসনা হলে চলেও যেতে পারত নিত্যানন্দপুরে| সত্যবতী কিন্তু ছিল সুবর্ণর ধরাছোঁয়ার বাইরে — একপক্ষের অনমনীয় জেদ, দুর্জয় অভিমান ও আত্মসম্ভ্রমবোধ, অপর পক্ষে ....... ? অপর পক্ষে অকস্মাৎ আশাভঙ্গের প্রচন্ড ধাক্কা, বিশ্বাস হারানোর বেদনা, ছোট মেয়েকে নিষ্ঠুর ভাগ্যের হাতে ফেলে রেখে আসার যন্ত্রণা এবং আরো অনেক বিপরীতমুখী আবর্তন|

মৃত্যুর আগে সত্যবতী সুবর্ণকে লিখে গেলেন তাঁর শেষ এবং একমাত্র চিঠি| কি লিখলেন একজন তেজস্বিনী সংসারত্যাগিনী মা তাঁর একমাত্র কন্যাকে? লিখলেন, “স্ত্রীলোকের যাহা কিছুতে অনধিকার, তাহার অধিকার অর্জন করিতে হইবে স্ত্রীজাতিকেই! কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের|’’ আরো লিখলেন, “মেয়েমানুষের একান্ত ইচ্ছা, তাহার সন্তান যেন তাহাকে বুঝে’’| শুধু এইটুকু আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সত্যবতী নিজেকে মেলে ধরেছিলেন সুবর্ণর সামনে|

আজ একশ বছর পেরিয়ে এসে সত্যবতী আর সুবর্ণলতার ট্রাজিডি দেখে কি মনে হয়? সত্যবতীর যে প্রতিজ্ঞা ছিল কোনোমতেই সে হার মানবে না| চরম বিশ্বাসঘাতকতার মুহূর্তে যে অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল, সারা জীবন তার মূল্য দিতে হয়েছে তাকে| সত্যবতী জানত বাবার কাছে সে আশ্রয় পাবেই| সুবর্ণ হেরেছে প্রতি পদে| যখন সুবর্ণর আশ্রয় দরকার ছিল, তার বাবা আর দাদা তাকে নিরাশ করতে দ্বিধা করেনি| এমনকি সত্যবতীও শেষ জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন সুবর্ণর জন্য হয়ত তাঁরও কিছু করণীয় ছিল, যা তিনি করতে ব্যর্থ হয়েছেন| সুবর্ণর জীবনের প্রেক্ষাপটে কোনো উজ্বল ব্যক্তিত্বের আশ্রয় ছিল না, তাই কি তার সারা জীবন পদে পদে অসম্মাননার লজ্জা?

এই কাহিনী কি আমরা আজও পুনরাবৃত্ত হতে দেখি না?

সুবর্ণর আটটি সন্তান, চার ছেলে, চার মেয়ে| বড় তিন ছেলে অবিকল তাদের বাবা-কাকার প্রতিমূর্তি, যাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য মেয়েমানুষকে পায়ের তলায় রেখে দেওয়া, প্রয়োজন হলে দৈহিক বল প্রয়োগ করে| বড় দুই মেয়ে মা’র চেয়ে ঠাকুরমা'র ভক্ত বেশি, কারণ ছোট থেকেই তারা দেখেছে বাড়িতে তাদের মা সকলেরই সমালোচনার পাত্রী| সুবর্ণলতার বহুদিনের সাধ মেটানো সুন্দর বাড়ি, যা কি না তার একার পরিবাবরের জন্যে, সেটিকে তাদের বাপের বাড়ি বলে মনেই হয় না| সেই নয় বছর থেকে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা সুবর্ণ তাহলে কার কাছে ভালোবাসা পেল, কে তাকে সম্মান জানালো – জীবনে বা মরণে?

তাহলে কি সুবর্ণ হেরেই গিয়েছিল? জয়-পরাজয়, বিশেষ করে মেয়েদের জীবনে, বোঝা কি অতই সহজ? সুবর্ণর দিনলিপি ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়ে এলে তার কাগজের মান আর ছাপার ভুল দেখে যখন বাড়িতে উপহাসের বন্যা বয়ে গেল, একদিন সুযোগ বুঝে সে সব একসঙ্গে আগুনে সমর্পণ করল| সেদিন কাগজ পোড়ার গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছিল বকুল, সুবর্ণর অষ্টম গর্ভের সন্তান| সুবর্ণর মুখের রেখায় আগুনের আভার ঝলকে কিসের ইতিহাস আঁকা দেখেছিল সে — পরাজিত সৈনিকের আত্মধিক্কারের না জীবনব্যাপী দুঃসহ সংগ্রামের?

সুবর্ণলতার মৃত্যুর পর বকুল তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল যদি কোনো খাতা বা লেখা হাতে পড়ে| পায়নি কিছুই| তখনই তার মনে হয়েছিল অন্ধকারের বোবা যন্ত্রণার ইতিহাস লেখাই বোধহয় ঋণশোধের একমাত্র পথ| সেই পাথেয় নিয়েই কি সে এগিয়ে গেল সুবর্ণর মৃত্যুর পরে মাথা উঁচু করে?