লম্বী জুদাঈ


#

আদি কবি বাল্মীকির কাব্য প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল ক্ৰৌঞ্চ মিথুনের বিরহ ব্যথায়। জীব জগতের বিরহ ও মিলন নিয়ে তারপর ও বহু কাব্য রচিত হয়েছে । কিন্তু জড় বস্তুদের মিলন বা বিরহ গাথা আমার মতো ভুলো মন, অগোছালো লোকজন ছাড়া কারুর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।  সেই গল্পই বলি। তবে তারও আগে  প্রাতঃস্মরণীয় শ্রী শরৎ চন্দ্র চাটুজ্যের বহুজন বিদিত গল্প মনে করিয়ে দেওয়া যাক।  নাটক দেখে ফেরার সময়  সাহিত্যিক মশাই একপাটি জুতো খুঁজে পেলেন না।  তিনি ওই এক পাটি জুতো বগল দাবা করে বাড়ির পথে রওনা হলেন জুতোচোরকে ফাঁকি দেবেন বলে।  ফেরার পথে সেই এক পাটি জুতো  গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফিরলেন।  পরের দিন নাটকের হল- মালিক অন্য পাটি জুতো এনে হাজির। সেটি নাকি চেয়ার এর তলায় ঢুকে গিয়েছিলো। শরৎ বাবু ওই অন্য পাটি জুতো  নিয়ে কি করেছিলেন তা অবশ্য জানা যায় না।

চটি বা জুতো হারানো বেশ সাধারণ ব্যাপার।  মন্দির এর সামনে থেকে বা বিয়েবাড়ির ভিড়ে একপাটি, এমনকি দুপাটি জুতোও অনেক সময় খোওয়া যায়।  আমি প্রথম প্রথম এই ব্যাপারে খুব বিচলিত হতাম। পরে যখন দেখলাম, এটি নেহাতই সাধারণ ঘটনা, তখন ঠিক করলাম আমিও অন্যের জুতো পরে  চলে আসবো।  তবে এই ভাবনা কার্যে পরিণত করা বেশ শক্ত। কারণ আমার সঙ্গে যাদের যাতায়াত, তাদের চোখ এড়িয়ে ব্যাপারটা করতে হবে।  না হলে যে পরিমাণ চিৎকার হবে তাতে ভূমিকম্প হওয়া অসম্ভব নয়। সারা জীবনে বহুবার জুতো হারালেও মাত্র একবার আমি একা থাকায় এবং দুপাটি জুতোর একটিও খুঁজে না পেয়ে অন্য এক জোড়া জুতো পরে চলে এসেছিলাম। তারপর বেশ কিছুদিন ভয়ে ভয়ে ছিলাম সিন্ডারেলার রাজপুত্রের মতো কেউ যদি আমার ফেলে আসা জুতো জোড়া নিয়ে হাজির হয়!!

ছোটবেলায় প্রায়ই উপহার পেতাম ফাউন্টেন পেন আর ডট পেন এর সেট।  ডট পেন গুলো বাক্স থেকে প্রথমেই বেরিয়ে আসতো কারণ কালি ভরতে হতো না, সহজেই ব্যবহার করা যেত।  ফাউন্টেন পেন বাক্স থেকে বেরোতো খালি পরীক্ষার সময়। তখনও পরীক্ষায় ডট পেন ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায় নি।  তারপর যখন সেই অনুমতি পাওয়া গেলো, ফাউন্টেন পেন পড়ে রইলো দেরাজের এক কোণে।

প্রিয় কলমের ঢাকা হারিয়ে যাওয়ায় অনেক কলম কালি শুকিয়ে অকেজো হয়ে যেত।  সেগুলো প্রাণে ধরে ফেলে দেওয়া যে কি কঠিন কাজ, যারা করেছে তারাই জানে। অবশ্য উল্টোটাও হতো অর্থাৎ কলম হারিয়ে গেছে, ঢাকা রয়ে গেছে, সেগুলোকে পত্রপাঠ বিদায় করতেই হতো।

ছোটবেলায় ছিল ইরেজার লাগানো পেন্সিল। ওই ইরেজারটার প্রতিই ছিল দুর্বলতা।  সেটা পেন্সিল শেষ হবার অনেক আগে শেষ হয়ে যেত, পেন্সিল পড়ে থাকতো অনাদরে। আর  ছিল লাল- নীল পেন্সিল। দুটো কখনো একসঙ্গে শেষ হতো না কিন্তু একটা শেষ হলে অন্যটার কদর কমে যেত।

বাবাকে অফিস ট্যুরে ভারতের নানা জায়গায় যেতে হতো। বাবা নানা রকম জোড়-পুতুল নিয়ে এসেছিলো, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড থেকে। সেগুলো যে ঝুলন বা রথের পুতু্লের থেকে আলাদা, সেটা বুঝতুম। কিন্তু তাতে তাদের ওপর অত্যাচার কিছু কম হতো না। একদিন জোড় ভেঙে যেত, পুতুল গুলো তাদের অভিনবত্ব হারিয়ে ফেলতো আর আলমারির ধুলোয় আরো ম্লান হয়ে যেত।

অস্ট্রেলিয়া ঘুরে মুগ্ধ চিত্তে বাড়ি ফেরার পথে কিনে ফেললাম ওপাল এর কানের দুল। কি অপূর্ব রং। যেন সদ্য দেখা সমুদ্রের ঢেউ। এয়ারপোর্ট এর ওয়াশরুম এ দেখি এক কানে দুল, অন্য কান খালি। কান্না পেয়ে গিয়েছিলো।  সেই একটি দুল এখনো রাখা আছে, তবে সে একলাটি নয়, তার অনেক বন্ধু বান্ধবী জুটেছে এতদিনে, এক কানের দুল দিয়ে একটা এক্সিবিশন করার কথা ও ভেবেছি।

কাপ ভেঙে গেলে প্লেট গুলো নানা কাজে ব্যবহার হয়েই যায় কিন্তু প্লেট ভাঙা কাপ গুলো বিশেষ কাজে আসে না, হাবিজাবি জিনিস রাখা ছাড়া। এক সময় যেসব  দেমাকি কাপ আলমারির শোভা বর্ধন করতো, জুড়ি ভেঙে সে যেন বিধবা হয়ে যেতো ।

সেলাই করতে গিয়ে দুটো ১০ নম্বর কাঁটা বা দুটো বারো নম্বর কাঁটা প্রায় ই খুঁজে পেতাম না। দুটো দু রকম কাঁটা দিয়ে দিব্যি চালিয়ে দিয়েছি। অভিজ্ঞ চোখে নিশ্চয় ধরা পড়তো, কিন্তু তা নিয়ে আমায় কখনো বিব্রত হতে হয় নি।

জামাকাপড় কাচতে দিলে সব গুলো ঠিকঠাক গুছিয়ে তোলা যে কি কঠিন ব্যাপার। আমার ধারণা ছাদে মেলে দিলে ওদের প্রাণে বেজায় ফুর্তি লাগে।  কিছু দুঃসাহসী কাপড় তাই বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে, তারপর রাস্তা হারিয়ে ফেলে নিজেরা ও হারিয়ে যায় বা নতুন ঠিকানা খুঁজে নেয়। এই অসামান্য বিশ্বাসে হারিয়ে যাওয়া  ম্যাচিং বালিশের কভার না খুঁজে, অন্য সেটের জিনিষ এনে চালিয়ে দিই । আর মিক্স এন্ড ম্যাচ এর যুগে মেলানো  ব্লাউস বা সঠিক কামিজ খুঁজে না পেলেও শাড়ি পরতে বা সালোয়ার পরতে অসুবিধে হয় না।  কিন্তু দুটো জানলায় দু রকম পর্দা নেহাত বেমানান। আমার সংসারে দরজা জানলার পর্দার সেট তাই চলতেই থাকে বছরের পর বছর, যতদিন না সবটাই আবার নতুন কেনা হয় ।

কিন্তু মুশকিল হয় সিদ্ধার্থকে নিয়ে।  সে জামা কাপড়ের বেড়াতে যাবার থিওরি তে  বিশ্বাস  করে না।  আর এক জোড়া মোজা মিক্স এন্ড ম্যাচ করে পরতে বলাও যায় না।  অথচ ওর এক পাটি মোজাই হারায় সব চেয়ে বেশী । ”মোজার মজা” এই জাতীয় “পান” করেও চিৎকার বন্ধ করা যায় না।  একবার দোল এর সময় প্রচুর কাচাকুচির পর দেখা গেলো, সিদ্ধার্থর এক পাটি মোজা পাওয়া যাচ্ছে না।  সে মোজা নাকি বিদেশ থেকে কেনা।  যা হোক, ওই  এক পাটি মোজাই  যত্ন করে তুলে রাখি, একদিন অপর পাটি ঠিক পাওয়া যাবে, এই আশায়। পুজোর আগে আবার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাত আবিষ্কার করি, সোফার পিছনে অন্য মোজাটি শায়িত। বিস্তর খাতির করে সেটিকে উদ্ধার করে, নিজের হাতে কেচে জোড়ার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে  আলমারির একদম আলাদা খোপে ঢুকিয়ে দিই।  “লম্বী জুদাঈ” বলে কথা, ওরা একটু নিজেদের মত সময় কাটাক। এই ফাঁকে আমরাও খুঁজে দেখি আরো কোনো ভেঙ্গে যাওয়া জোড় মেলানো যায় কি না ।