পুজো সংখ্যা


#pujo #magazine

পুজোর বই পড়া

ছোটোবেলায় দুর্গাপুজোর সঙ্গে পুজো সংখ্যার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল| মহালয়ার আগে আগে প্রকাশিত হত শারদীয়া আনন্দমেলা, শারদীয়া কিশোরভারতী, শারদীয়া সন্দেশ, শারদীয়া শুকতারা, দেব সাহিত্য কুটীরের একটা সাহিত্য-সংগ্রহ যার নাম বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন হত| এক বছরের নামটাই মনে আছে, তপোবন| পঞ্চাশ বছর আগে এদের দাম ছিল দু-টাকা, চার টাকা বা আট টাকা| তাও সবকটি এক বাড়িতে কেনার কোনো প্রশ্নই উঠত না| আগে থেকে ঠিক করা থাকত, আমি যদি আনন্দমেলা কিনি, পাশের বাড়িতে কেনা হবে কিশোরভারতী আর সামনের বাড়িতে শুকতারা| সন্দেশ তো পাবই, কারণ আমি তার গ্রাহক| এমনকি কে কোন অর্ডারে কোন পুজো সংখ্যা পড়বে, তাও ঠিক থাকত| সে নিয়মের ব্যাত্যয় হলে নানান ঝগড়াঝাঁটি চলত মাসখানেক ধরে|

শারদীয়া আনন্দমেলায় পর পর বছরে প্রকাশিত হয়েছিল মতি নন্দীর স্ট্রাইকার, স্টপার, কোনি, অপরাজিত আনন্দ; প্রথম কাকাবাবু ─ ভয়ংকর সুন্দর| সন্দেশে বেরত ফেলুদা আর আনন্দমেলায় প্রফেসর শঙ্কু| কিশোরভারতীতে বেরত নাম তার ভাবা| আরো ছিল ─ রুনু বলে একটি কিশোরের গ্রাম থেকে বরিশাল শহরের স্কুলে পড়তে আসার গল্প; বিনয়-বাদল-দীনেশের অলিন্দ-যুদ্ধ, বাঘা যতীনের যুদ্ধ বুড়িবালামের তীরে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ| কয়েক বছর আগে পত্রভারতীর দোকানে ঐ সব পুরনো সংখ্যার খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু সে আর পাওয়া যায়নি| তবে দেব সাহিত্য কুটীর সত্তর দশকের শারদীয়া সংখ্যাগুলি পুনর্মুদ্রণ করছে দেখলাম|

কলেজে পড়ার সময়ে, অর্থাৎ আশির দশকে, পর পর দুবছর হরবোলা নামে একটি শারদীয়া সংখ্যা হাতে এসেছিল| অনুবাদ সাহিত্য, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত| তাতে দুটো গল্প পড়েছিলাম, টোকোলাশ আর হারিকেন| প্রথমটি দক্ষিণ আফ্রিকার রূপকথা, দ্বিতীয়টি West Indies-এর কোনো একটি দ্বীপের একটি বালকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা| আমফানের তান্ডবের মধ্যে যে কতবার সেই গল্পটার কথা মনে পড়েছে কি বলব!

শারদীয়া উল্টোরথ কেমন করে যেন হাতে এসেছিল এক-আধবার| আমার বাড়িতে কখনোই কোনো বই পড়া বারণ ছিল না| তবুও সম্ভবত বন্ধুদের জ্ঞানবিতরণের কারণে জেনে গিয়েছিলাম যে নবকল্লোল আর উল্টোরথ লুকিয়ে পড়ার বস্তু! এখন অবশ্য দেখলাম শারদীয়া নবকল্লোলকে Literature (of) Young Adult এই বিভাগে ফেলা হয়েছে

আনন্দমেলা- কিশোরভারতীর বয়স পেরোনোর পরে নানান কারণে শারদীয়া সংখ্যার প্রলোভন কমে গিয়েছিল| এবার গৃহবন্দীদশায় দেখলাম মাতাঠাকুরাণী পাঁচখানি শারদীয়া কিনেছেন, এবং নাক কুঁচকে উল্টেপাল্টে দেখছেন| কটি পড়েছেন জানতে চাওয়ায় যে উত্তরটা পেলাম তা অনেকটাই খাচ্ছে-কিন্তু-গিলছে-না গোত্রীয়| শারদীয়াগুলি হল এই সময় (৫০/-), বর্তমান (৬০/-), নবকল্লোল (১১০/-), পত্রিকা (১২০/-) এবং আজকাল (১৫০/-)| এদের হাতে নিয়ে আমার অন্তরের রাশিবিজ্ঞানী প্রাণীটি একটু চোখ মিটমিট করে উঠল|

প্রথমেই দেখলাম এদের পাতার সংখ্যা ৩৩৬ - ৪০২-এর মধ্যে| তার মানে পাতার সংখ্যার ওপর মূল্য নির্ভর করছে না| এমনকি এ ও দেখা গেল যে পাতার সংখ্যা বাড়লে দাম একটু কমতেও পারে!! (Sample correlation -14%)

সাধারণত একটা শারদীয়াতে থাকে কবিতা, উপন্যাস, বড় গল্প, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী প্রভৃতি| কোনো কোনো সংখ্যায় আবার বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস, অলৌকিক গল্প, রহস্যোপন্যাস ইত্যাদি ভাগও থাকে| বর্তমান  আর পত্রিকাতে একটিও কবিতা নেই| অন্য তিনটি শারদীয়াতে ঠিক ১০০টি কবিতা আছে| কবির সংখ্যা অবশ্য শতেকের অনেক কম, কারণ চার-পাঁচ জনের একাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, এমনকি একই শারদীয়াতে| তার মধ্যে শ্রী সুবোধ সরকার অগ্রগণ্য, তাঁর এক ডজন, অর্থাৎ গুনে গুনে ১২টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে এই সময়ে| রবীন্দ্রনাথ যখন একাধারে বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনা করছেন এবং আরো অন্যান্য পত্রিকায় লিখছেন, তখনও কি কোনো একটি পত্রিকার একটি সংখ্যায় তাঁর এতগুলি কবিতা কখনো ছাপা হয়েছে? অন্য দুটিতেও সরকার-কবির কবিতা রয়েছে| এই সময়ে  অবশ্য আরো দুজন আধ ডজন করে কবিতা লিখেছেন – অভীক মজুমদার ও সব্যসাচী সরকার| পাঁচটি করে কবিতা লিখেছেন তিনজন কবি, চারটি করে দুজন আর তিনটি কবিতা লিখেছেন একজন| তিনটি শারদীয়া মিলিয়ে কবির সংখ্যা সাকুল্যে ৫২, তার মধ্যে ৪৩ জনই, অর্থাৎ ৮০% পুরুষ|

পাঁচটি পত্রিকাতেই উপন্যাস রয়েছে, দুটি, তিনটি বা চারটি| একমাত্র বুদ্ধদেব গুহ ছাড়া, কেউই দুটি উপন্যাস লেখেননি| কোনো মহিলা উপন্যাসলেখকও দেখলাম না|

এবার তাকানো যাক গল্পের দিকে| পত্রিকাতে বড় বা ছোট কোনো গল্পই নেই| অন্য চারটি শারদীয়া মিলিয়ে মোট ৫৯টি ছোট-বড় গল্প রয়েছে| ছ জন লেখকের দুটি করে গল্প রয়েছে, অবশ্যই এক শারদীয়াতে নয়! এঁরা ছাড়া আরো দু-একজন আছেন যাঁরা ভিন্ন শারদীয়াতে কবিতা আর গল্প বা উপন্যাস আর গল্প লিখেছেন| গল্প লেখকদের মধ্যেও ৮০% পুরুষ|

পাঁচটি শারদীয়াতে দুটি মাত্র নাটক আছে, দুটিই সৌমিত্র চ্যাটার্জির এবং দুটিই P G Wodehouse-এর অনুবাদ!

গল্প বা উপন্যাসের বিষয়বস্তুর মধ্যে আমি ঢুকব না| তার চেয়ে প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তুর আলোচনা করা সহজ| মূল বিষয় অনুযায়ী ভাগ করলে দেখি জীবনীমূলক, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী ছাড়া বিনোদন অর্থাৎ সিনেমা বা গানের জগতের তারকাদের ব্যাপার-স্যাপারের সঙ্গে রয়েছে ফ্যাশান, খাওয়া-দাওযা ইত্যাদি| এগুলি ছাড়া যা রয়েছে তাদেরকে সাধারণ বিভাগের অন্তর্গত বলা যেতে পারে|

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে আমার একটা কথা সবসময়েই মনে হয় যে উনি না জন্মালে বাংলা ভাষা অমূল্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত হত শুধু তা নয়, রবি ঠাকুর নামক বিরাট ব্যবসায়টিও যে থাকত না| রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন প্রায় ৮০ বছর আগে| আজও তাঁর নামে প্রতি বছর যত বই প্রকাশিত হয় বা যতগুলি প্রবন্ধ লেখা হয়, তার একটি census রাখার প্রয়োজন আছে| শারদীয়া সংখ্যাও তার ব্যতিক্রম নয়| এই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধ রয়েছে, আজকালেও তাই| চারটি প্রবন্ধের লেখক সংখ্যা তিন|

রবীন্দ্রনাথের পরেই জনপ্রিয়তার নিরিখে সম্ভবত রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের স্থান| তাঁদের নিয়েও দুটি প্রবন্ধ রয়েছে বর্তমাননবকল্লোলে, যথাক্রমে শংকর ও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের| সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বর্তমানেও লিখেছেন, সীতাকে নিয়ে| রাম-মন্দিরের আন্দোলনেই কি না জানি না, রামায়ন সম্বন্ধে নিশ্চয় পাঠককুলের আগ্রহ বেড়েছে, কারণ পত্রিকাতেও রামায়নের আর এক নারী, কৌশল্যাকে নিয়ে একটি রচনা রয়েছে| এই দুটি রচনাই পুরাণধর্মী, অর্থাৎ মহাকাব্যকে নতুন মূল্যায়নের কোনো প্রচেষ্টা তাতে নেই| তা ছাড়াও হিন্দুধর্মাত্মক ‘বিশেষ আকর্ষণ’ প্রবন্ধ আরো অন্তত চারটি রয়েছে|

নবকল্লোল আর আজকালে রয়েছে জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত দুটি প্রবন্ধ, দুটিই জাদুকর পি সি সরকার জুনিয়ারের লেখা|

গত মার্চ মাস থেকে তো সারা পৃথিবীতে প্রধান খবর হল করোনা| অথচ আশ্চর্যজনকভাবে একটি মাত্র প্রবন্ধে করোনা তার ছাপ রেখেছে|

একটি মাত্র প্রবন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানের একটি প্রধান application, Artificial Intelligence নিয়ে আলোচনা হয়েছে| সম্পূর্ণ অন্য রকম একটি মাত্র প্রবন্ধ দেখতে পেলাম নবকল্লোলে, আন্দামানের বন্দীদের নিয়ে লেখা|

এত সব হিসেবের মধ্যে দিয়ে একটা কথাই বেরিয়ে আসছে যে, শারদীয়াগুলির মধ্যে বৈচিত্র্যের একান্ত অভাব| সেই একই লেখকের দল ঘুরে-ফিরে লিখছেন – কোথাও প্রবন্ধ, কোথাও কবিতা, কোথাও ছোটগল্প আর কোথাও উপন্যাস| তাঁদের মধ্যে কেউ বিখ্যাত, কেউ বা অত খ্যাতনামা নন, কেউ হয়ত নেহাতই নবাগত| মহিলা সাহিত্যিকদের অনুপস্থিতি নজর কাড়ে| আরো একটি বিষয় আমার চোখে পড়েছে, তা হল লেখকদের পদবীর uniformity! কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের গুণগত মান সম্বন্ধে আমি কোনো মন্তব্য করছি না| কিন্তু যদি পাঁচটি শারদীয়াতে কেউ পঞ্চব্যঞ্জনের স্বাদ চান, তাহলে তাঁকে নিতান্তই নিরাশ হতে হবে| তবে হ্যাঁ, রান্নাবান্নার ব্যাপারে কিছু স্বাদতারতম্য লক্ষ্যণীয়! কোথাও গোয়া, কোথাও বা পার্শী খাবারের কথা আলোচনা করা হয়েছে| ভ্রমণকাহিনীতেও বৈচিত্র্য রয়েছে – বিশেষত বিদেশে বেড়ানোর বর্ণনায়|

কি আছে-র চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই শারদীয়াগুলিতে কি নেই| গত মার্চ মাস থেকে আমাদের সকলেরই জীবন থমকে গিয়েছে – অনেকের ক্ষেত্রে একেবারেই; বাকিরা একটা ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে অন্ধের মত ঘুরপাক খাচ্ছি| কবে যে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাব, কে জানে| Social mediaতে সামান্য ঘটনা অবলম্বন করে অসংখ্য কবিতা, চোখের-জলে ভেজা সত্যি (বা মিথ্যা) গল্প, বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে অবিজ্ঞান – কত কীই তো নজরে পড়ে| অথচ শারদীয়াগুলি প্রধানত সে বিষয়ে মূক| সাহিত্য কি আর তাহলে চলমান জীবনের ছবি নয়? গত একশ বছরের চেয়ে ২০২০ সাল যে অন্যরকম, তার পরিচয় তো এই সংখ্যাগুলি থেকে পাওয়া গেল না|

এমনও বলতে চাই না যে এ বছর প্রকাশিত কোনো শারদীয়াতেই মহামারী বা পৃথিবীর গভীরতর ব্যাপকতর অসুখ তার ছাপ রেখে যায়নি| কোরক সাহিত্য পত্রিকা যেমন কেবলমাত্র অতিমারী নিয়েই শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করেছে, কিন্তু সেটি আমি জোগাড় করে উঠতে পারিনি| যে কটি শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলি random sample নয়| তবুও এগুলি বহুল প্রচারিত – সর্বাপেক্ষা বেশি প্রচারিত যদি না ও হয়|

যদিও জানি ছোটদের শারদীয়া আর বড়দের শারদীয়াকে একইভাবে বিশ্লেষণ করা হয়ত উচিত নয়, তবু চল্লিশ বছর আগের ছোটবেলায় পড়া বেশ কিছু রচনা এখনও মনে রয়ে গেছে| কেবল মাত্র nostalgia বলে তার ব্যাখ্যা করা যাবে না| এই শারদীয়া সংখ্যাগুলিতে প্রকাশিত রচনা আগামী বছর পুজো অবধি মনে থাকবে কি?