মোর ঘুম ঘোরে


#

যেকোনো পরিস্থিতিতে ঘুমিয়ে পড়ার যে বিশেষ প্রতিভা নিয়ে আমি জন্মেছি, আমার পরিবার বা বন্ধু মহলে তার কোন কদর হয়নি বরং চিরকাল সেই প্রতিভা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেবার প্রয়াস চলে আসছে।

 এ ব্যাপারে প্রথম ব্যক্তি হলেন আমার মা। তিনি চিরকাল ব্রাহ্ম-মুহূর্তে উঠে পড়েন এবং তা‍ঁর ধারণা, ঐ সময়ে পড়াশোনা করলে তাড়াতাড়ি পড়া মাথায় ঢোকে এবং সারা জীবন মনে থাকে। তাই আমাকে ভোরবেলা ডেকে তোলার বিস্তর চেষ্টা করেছেন, দুধ, হরলিক্স, চা, নানা কিছু আমার মুখের সামনে ধরেছেন, কিন্তু তিনি পিছন ফিরলেই আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছি।

 

 আমার ছেলে আবার নিশাচর প্রকৃতির। তাকে ঘুম পাড়াতে বসে আমি নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। সিদ্ধার্থর বড়ই আক্ষেপ যে, ছেলের জন্য রাত জাগার যাবতীয় কষ্ট ওকে স্বীকার করতে হয়েছে কিন্তু ছেলে বেশি মা ঘেঁষা হয়েছে। তবে রাত জাগলেও বুবকা সেই ঘুম পুষিয়ে নেয়। একবার কোথাও বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে মা ও ছেলে ট্যাক্সির ভেতর ঘুমিয়ে কাদা। বাড়ির কাছাকাছি এসে ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করল এবার কোন দিকে? চোখ খুলে ২৫ বছরের চেনা রাস্তা আর চিনতে পারিনা। এই গল্প শুনে বাড়ির লোক এই মারে তো সেই মারে! যদি দুষ্টু লোক হতো! যদি তোদের নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতো! এরকম ঘটনা আমার জীবনে বহুবার ঘটেছে, কেউ আমাকে সঠিক গন্তব্য ছাড়া অন্য কোথাও নিয়ে যায়নি, কিন্তু বাড়ির লোকেদের বকুনি বা নিন্দা তাতে কমেনি।

 

 এইতো সেদিন লুধিয়ানা থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা ফেরার কথা। লুধিয়ানা দিল্লি উড়ান বাতিল হয়ে গেল। গাড়ি ভাড়া করে চললুম দিল্লি। ৫ ঘন্টার ওপর সময় লাগে। জেগে থাকা যায়! ঘুমিয়ে পড়েছি। সিদ্ধার্থ কল করে পায়নি। উদ্বিগ্ন হয়ে ড্রাইভারকে ফোন করেছে। ড্রাইভার বলেছে, "বিবিজি শো রহা হ‍্যায়।" তারপর আমাকে ডেকে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। ফোনে সিদ্ধার্থ কি বলল, সে কথা না হয় না বলাই থাক।

 

ট্রেনের দুলুনিতেও আমার চমৎকার ঘুম পায়। বাংকে উঠে শুতে যেটুকু দেরি। যদিও আমার বিশেষ পছন্দ মাঝের সীট। ঘুম ভেঙে গেলে মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখা যায়। কোন স্টেশন পেরিয়ে গেল, ঝমঝম শব্দ হচ্ছে কেন?ওহো, এটা তো ব্রিজ পেরোনোর শব্দ, এইসব দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে আবার দুচোখে ঘুম নেমে আসে। কিন্তু নিচের সহযাত্রী নিদ্রাহীন হলে বিশেষ অসুবিধে। মাঝের সীট খোলা থাকলে তিনি সোজা হয়ে বসতে পারেন না। নিচের সীটেও একই অসুবিধে। সহযাত্রীরা উঠে পড়লে বসার জন্য ছটফট করে, ফলে ঘুমের আমেজ থাকলেও উঠে বসতে হয়।

 একবার তিন বান্ধবী গেছি দার্জিলিং বেড়াতে। ম‍্যালে গিয়ে বাকি দুই বন্ধু একটা দোকানে ঢুকে এন্টিক জুয়েলারি দেখা শুরু করল। ছোট দোকানের ভেতর টা জিনিসপত্রে ঠাসা, দমবন্ধ পরিবেশ। অথচ বাইরে চমৎকার ঠান্ডা হাওয়া, কুয়াশার চাদরে ঢাকা রোমান্টিক বিকেল। আমি আস্তে আস্তে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে একটা বেঞ্চে বসলাম এবং তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম। ওরা কেনাকাটা করে বেরিয়ে এসে আমাকে ডেকে তুলে প্রচুর ভর্ৎসনা পূর্বক জানালো যে ম‍্যালের সব ঘোড়াগুলো নাকি তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কে একবার করে দেখে গেছে। নেহাত ঘুম থেকে উঠেই নাথমুলের চা পান করলে মন হিমালয়ের মতো উদার হয়ে যায়, তাই এসব অর্বাচীনদের অনায়াসে ক্ষমা করে দেওয়া গেল।

 

 কিন্তু প্রতিভা কখনো চাপা থাকে না, একদিন না একদিন তার কদর ঠিকই হয়। সেই গল্প বলেই ফেলি। একবার উড়োজাহাজে লম্বা সফরে আমি একা। সিট দেখে ভারি খুশি। ৩ সিটের একটি নয়, দুটি সিটের জানলার ধারের সীট। সহযাত্রীটিও বাঙালি। প্রাথমিক পরিচয় চটপট সারা হলো। উড়ান শুরুর কিছুক্ষণ পরে খাবার এলো। তারপর ভদ্রলোক বললেন, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলব। আমি খাওয়ার পরে ঘুমের ওষুধ খাই, একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়বো। আপনার ওঠার দরকার হলে খুবই অসুবিধে হবে। তাই আপনি যদি এদিকে এসে বসেন। আমি তখন চমৎকার একটি সিনেমা দেখছিলাম। উনি চটপট ওনার দিকের টিভিতে সেই সিনেমাটা ঠিক সেই জায়গায় সেট করে দিলেন। আমরা জায়গা পরিবর্তন করলাম। সিনেমা দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি, জেগে উঠে দেখি ভদ্রলোক মুগ্ধ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনাকে ঘুমের জন্য কোন ওষুধ খেতে হয় না, না ? আমি জানালাম, আমার ঘুমের কোন সমস্যা নেই। সেটাই তো দেখলাম, ভদ্রলোক আপ্লুত স্বরে জানালেন, ওষুধ ছাড়া আপনি কি চমৎকার ঘুমালেন! অথচ ওষুধ খেয়েও আমার  একটুও ঘুম হল না। আর যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি নিজের সিটে আবার ফেরত আসবেন? একটু টয়লেট যাওয়া প্রয়োজন। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন বলে বিরক্ত করিনি।

 হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বলে উঠে দাঁড়ালাম। মনে মনে বললাম এই দাঁড়ানোটা নিছক সীট পরিবর্তনের জন্য নয় কিন্তু, আমার ঘুমের একমাত্র প্রশংসাকারী কে আমার সপ্রাণ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।