ফিরে এসো চাকা


#

বাবা মা বিয়ের পর কোনারক বেড়াতে গিয়েছিলো, এলবামে সেই ছবিগুলো আমার ভারী প্রিয় ছিল। সুবিশাল চাকার মধ্যে কি এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য এবং আকর্ষণ। ক্লাস নাইন এ যখন উঠলাম, বিড়লা সাইন্স মিউজিয়াম থেকে একটা কুইজ কনটেস্ট আয়োজন করলো, আর স্কুলের ৪ জনের টীম এ আমিও একজন নির্বাচিত হলাম। প্রথম রাউন্ড এ ওই মিউজিয়াম এর বিভিন্ন গ্যালারি থেকে প্রশ্ন হবে। আমরা ৪ জন গ্যালারি ভাগ করে নিলাম। আমি নিলাম এক তলায় ট্রান্সপোর্ট গ্যালারি, গ্যালারির প্রবেশদ্বারে সেই প্রিয় কোনারক এর চাকা। সঙ্গে লেখা, এই চাকা হলো সময়ের প্রতীক।কোনারক সূর্য মন্দির, সূর্যদেব সাত ঘোড়ার রথে চড়ে আকাশ পরিক্রমা করেন, সেই রথের ২৪ টি চাকা, ২৪ ঘন্টার প্রতীক, আর প্রতি চাকায় ৮ টি দণ্ড ৮ প্রহরের প্রতীক। তারপর গ্যালারির ভেতরে যে কত তথ্য।চাকার আবিষ্কার থেকে মোটর গাড়ি, এরোপ্লেন, এমন কি বুলেট ট্রেনের কথা পর্যন্ত জানতে পেরেছিলাম।

বিদেশ থেকে বড়মাসী এনে দিয়েছিলেন কুট্টি কুট্টি গাড়ি, তার সামনের দরজা, পিছনের দরজা খোলা যেত, বনেট, ডিকি তোলা যেত, কি যে অপূর্ব ছিল সে জিনিস। আমাদের ভালোবাসার অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে মা সেটিকে শো কেসে তুলে রেখেছিলো। 

এরপর আমাদের নিজেদের গাড়ি কেনা হলো। মার্ক টু এম্বাসেডর । বাবা শনিবার সেই গাড়ি নিয়ে আমাদের স্কুল থেকে আনতে যেতেন। এছাড়া ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া ও হতো। আমার খুব শখ বাবার মতো গাড়ি চালাবার। বাবা বললেন, ১৮ বছর হোক,তারপর।

হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হতে বাবা বললেন,গাড়ি চালানো শিখবি? আমি তো এক পায়ে খাড়া, লার্নার লাইসেন্সের এপ্লাই করা হলো, গাড়িতে লাল রঙের “L” লেখা বোর্ড ঝুলল। আমরা ভোরবেলায় উঠে সল্ট লেকে যেতাম।তখন সল্ট লেক ফাঁকা ফাঁকা ছিল। কিছু বাড়ি পুরো তৈরী হয়েছে, অধিকাংশ জায়গায় বাড়ি তৈরির কাজ চলছে।কিছুদিনের মধ্যে চালাতে শিখে গেলাম। এবার লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিতে হবে। প্রথমে চালিয়ে দেখাতে হবে, তারপর ওরা কিছু প্রশ্ন করবে, উত্তর দিতে হবে। বাবা কিনে আনলেন একটা ছোট বই, তাতে গাড়ির পার্টস এর নাম, সাইন চিহ্নর মানে, আরো কি কি সব ছিল, পড়ে ফেললাম চটপট, মুখস্থ ও হয়ে গেলো, খুব কনফিডেন্স নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম।প্রথম চালানো দেখে ট্রেনার বললো, এবার ৩ পয়েন্ট ইউ টার্ন নাও। সে কি বস্তু! জীবনে শুনি নি। উনি বললেন ৩ বারের চেষ্টায় গাড়ির মুখ উল্টো দিকে ঘুরাতে হবে।সেটা করার সময় ব্যাক করতে গিয়ে ফুটপাথ এর সঙ্গে ধাক্কা লাগলাম।ব্যাস, ফেল। জীবনে প্রথম ফেল করে কি লজ্জা।অথচ যারা কোনো মোটর ট্রেনিং স্কুল থেকে এসেছিলো, তাদের সেভাবে কোনো পরীক্ষাই হলো না। বাবাও খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। আমাদের গ্যারেজ মালিক ডাকুদা কে বললেন, তুমি শেখাও।  ডাকুদার ট্রেনিং এ দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় পাস্ করলাম। এর মধ্যে হায়ার সেকেন্ডারি, জয়েন্ট এন্ট্রান্স সব রেজাল্ট বেরোলো, আর জি কর এ ভর্তি হলাম।মাঝে মাঝে গাড়ি চালিয়ে যেতাম, ড্রাইভার পাশে বসে থাকতো।

একবার হলো কি কলেজে একটা অনুষ্ঠান, কোনো কারণে ট্যাক্সি ধর্মঘট, গানের প্রতিযোগিতার একজন জাজ কে আনতে যাবার কথা, গাড়ির ও ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। আমি বললাম আমি নিয়ে আসি? উপায় না দেখে উদ্যোক্তারা রাজি হলেন, আমি দিব্যি তার বাড়ি গিয়ে তাকে ডেকে গাড়িতে বসলাম।এবার যখন তিনি দেখলেন, আমি ড্রাইভার এর সিট এ বসছি, তিনি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, আমি বললাম কোনো চিন্তা নেই, বলেই ধা করে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছি, যাতে নেমে যেতে না পারেন।  উনি অবশ্য সারা রাস্তা টু শব্দ করেন নি, বোধ হয় ইষ্ট নাম জপ করছিলেন, আমি বিনা ঝঞ্ঝাট এ ওনাকে কলেজে এনে কমন রুমে পৌঁছে দিলাম।এদিকে ডাকুদার কাছ থেকে বাবা খবর পেয়ে গেছেন, আমি একা ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছি, ফলে বাবা ডুপ্লিকেট চাবি সহ কলেজে হাজির হয়ে গাড়িতে বসে গেছেন। মোবাইল ছিল না বলে আমি কিছু জানতে বা জানাতে পারি নি। যাই হোক, কারো মাধ্যমে খবর পেয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলে সে যাত্রা রক্ষা পাই।ফেরার সময় সেই জাজ বেঁকে বসেন, আমার সঙ্গে ফিরবেন না বলেন।অবশেষে বাবার মধ্যস্থায় মধুরেণ সমাপয়েৎ।

ততদিনে ডাক্তারি পাস্ করেছি, বিয়ে হয়েছে, মুর্শিদাবাদ এর গ্রাম এ পোস্টিং হয়েছে। হেলথ সেন্টারে ছিল একটা মারুতি ৮০০। তেল থাকলে খারাপ রুগী নিয়ে সেই গাড়ি যেত বহরামপুর । একদিন শখ করে সে গাড়ি চালাতে গিয়ে কি বিপদ! মার্ক টু এম্বাসেডর গাড়িতে আমার পা এক্সেলেটর চাপতে অভ্যস্ত। মারুতি ৮০০ এ এক্সেলেটর এ পা ঠেকাতে হয় মাত্র। প্রথম দিন যে স্পিড এ মারুতি ৮০০ স্টার্ট নিলো, ড্রাইভার আমার হাত থেকে স্টিয়ারিং কেড়ে বললো, হবে না আপনার দ্বারা।

আমাদের সেই মার্ক টু এম্বাসেডর গাড়ি বিক্রি করে পরে কেনা হলো প্রিমিয়ার পদ্মিনী ফিয়াট গাড়ি। কলকাতা ফিরে ফিয়াট গাড়ি মাঝেসাঝে চালাতাম। ততদিনে দীর্ঘ অনভ্যাস, কনফিডেন্স ও আগের মতো নেই। একদিন ড্রাইভার ছুটিতে, কি ভূত চাপলো মাথায়, গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশে। মৌলালি মোড়ে একটা বাস কিছুতে সাইড দিচ্ছে না, পেছনে গাড়িগুলো হর্ন বাজাচ্ছে, আমি যাবো বাঁ দিকে, বড়ো করে বাস কাটাতে গিয়ে ধাক্কা মারলাম একটা ড্রাম এ।  তখন ট্রাফিক পুলিশরা ওই রকম ড্রামে মাঝে মাঝে দাঁড়াতো। সেদিন ড্রামটা ফাঁকাই ছিল। কারো কোনো ক্ষতি হয় নি, তবু পুলিশ এসে লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করলো। যথারীতি বাবার শরণাপন্ন হলাম। বাবা এসে ছুটির সময় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে থানা থেকে লাইসেন্স ছাড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। বাড়ি থেকে কড়া হুকুম হলো, যেন আর গাড়ি না চালাই। আমারো আর আগের মতো গাড়ি চালানোর শখ ছিল না।

আমার বোন, যে ছোটবেলায় গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে "বাবা বাঁচাও" বলে চিৎকার করে একজনের বাউন্ডারি ওয়ালে ধাক্কা দিয়েছিলো, সেও বিদেশে গিয়ে পাকা ড্রাইভার হয়ে গেলো। বন্ধুরা অনেকেই ওস্তাদ গাড়ি বিশারদ। অনেক আগে শুরু করেও আমিই শুধু উল্টো পথে হাঁটা লাগলাম।

তখন বরং বুবকার খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলতে বেশি ভালো লাগতো।বড়মাসীর আনা গাড়ি নিয়ে মনের মতো খেলতে না পারার দুঃখ আর নেই। কত রকম গাড়ি যে ছিল বুবকার, রিক্সা থেকে হেলিকপ্টার, শুধু মোটর গাড়িই কতো! তবে সুখ তো ক্ষণস্থায়ী, বুবকার খেলা কিছুদিনের মধ্যে পাল্টে গেলো, গাড়িগুলো একটু গেলেই ও সেটা উল্টে দিয়ে বলতো একসিডেন্ট। তারপর যতটা সম্ভব পার্টস খুলে ফেলতো, তারপর আবার সেগুলো জোড়া লাগতো। এটাই ছিল ওর গাড়ি নিয়ে খেলা। তাতে গাড়ি গুলোর আকার এক থাকলেও কার্য ক্ষমতা কমে যেত, কখনো আর চলতোই না। প্রতিবারই কিছু পার্টস বেশি থেকে যেত কি না!

বুবকার পরে বাড়িতে ছোট বাচ্চা এলো ননদের ছেলে, তারও একটা গাড়ি ছিল, ছোট লাল মিষ্টি গাড়ি , ওটায় ও চড়ে বসতে পারতো, ছোটবেলার এলবামে দেখেছি আমারো একটা ছোট গাড়ি ছিল, কিন্তু সেটার কথা আমার একটুও মনে নেই, আর সাদা কালো ছবি থেকে বোঝার উপায় নেই ওটা কি রঙের ছিল। সেই সময় একটা কার্টুন হতো, নডি। নডি থাকতো টয়ল্যান্ড বলে একটা জায়গায়, সে একটা লাল গাড়িতে চড়ে ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতো। পাড়ার "গো এস ইউ লাইক ইট কম্পিটিশন" এ ননদের ছেলে কে নডি সাজানো হলো, আমার আর ননদের যৌথ প্রয়াসে তার গাড়ির ও সাজ হলো নডির গাড়ির মতো। কম্পিটিশন এ ওকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কি সেজেছো? ও আধোআধো স্বরে বললো, নদী। জাজেরা কিছুই বুঝলো না। নদী গাড়ি চেপে কোথায় যেতে পারে, এ ব্যাপারে কারো ধারণা থাকা সম্ভব নয়।

তারপর তো সবাই বড়ো হয়ে গেলো, গাড়ি একটা নিত্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র ছাড়া আর কিছু না। বাচ্চাদের খেলনা গাড়িগুলো, যা নিয়ে একদিন কত ঝগড়া, তাও পড়ে রইলো অনাদরে, কিছু তো হারিয়েই গেলো।  

খুব ছোট বেলায় গল্প আর ছবি নামে একটা রাশিয়ান বই এর অনুবাদে একটা দারুন গল্প পড়েছিলাম, "নানা মাপের চাকা"।একটা কিম্ভুত গাড়ি ছিল, তার চারটে চাকা ছিল চার মাপের। সে গাড়ি জঙ্গলে পড়ে ছিল। একদিন চার বন্ধু চারটে চাকা খুলে বাড়ি নিয়ে গেলো।ছোট চাকা দিয়ে একজন বানালো সুতো কাটার তকলি, দ্বিতীয় চাকা দিয়ে একজন বানালো ঠেলাগাড়ি। তিন নম্বর চাকা একজন লাগিয়ে দিলো পাতকূয়ায়, জল তোলার ভারী সুবিধে। আর সবচেয়ে বড়ো চাকা দিয়ে বানানো হলো ময়দা বানানোর জল-কল।

এ গল্প, এখন বুঝি জীবনের এক শিক্ষা। কত বার তো পড়েছি, "জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা"। কিম্ভুত জিনিস থেকেও আহরণ করা যায় জীবনের রসদ। গাড়ি চালাই বা না চালাই, জীবনকে চিরকাল রাখতে হবে গতিময়!