শোনাপড়ালেখা


#

-বুবকা, মাস্ক পরছিস তো ঠিকমতো?

 -হ্যাঁ….

 -দেখি কেমন মাস্ক কিনেছিস।

 ছেলেপুলে বাইরে থাকলে ভিডিও কলিং জিনিসটাকে স্যালুট জানাতে ইচ্ছে করে।

-দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।

 একটু পরে ছেলে এল একটা কঙ্কালের মুখোশ পরে।

 -এটা কি?

-মাস্ক মানে মুখোশ ই তো জানি।

 -এটা কিনেছিস!! (তাই ভাবি এত লক্ষ্মী ছেলের মত মাস্ক দেখাতে রাজি হওয়ার মত বাধ্য ছেলে তো আমার না।)

 ঠিকই জানিস, তবে মাস্ক এর কাজ নাক মুখ ঢাকা আর তোর মুখোশে ও দুটোই খোলা।

চিরকালই অবশ্য বুবকার উল্টো স্বভাব, উল্টো বুদ্ধি।

একদম বর্ণপরিচয় থেকেই শুরু করা যাক। অ এ অজগর আসছে তেড়ে….এই বিখ্যাত পংক্তি দিয়ে কত লক্ষ কোটি বাঙালি বাচ্চার পাঠ শুরু। কিন্তু আমার উল্টো বাচ্চাটি পড়া শুরু করল, অ এ অজগর তেড়ে আসছে না, আমটি আমি পেড়ে খাব না, অর্থাৎ প্রতিটি বাক্যের পর একটি না যোগ করে। সত্যিই তো এসব ঘটনা ঘটছে না। পরবর্তী পর্যায় অবশ্যই স্কুল। ইংরেজি পাঠের কিছু নির্ভেজাল সত্যি গল্প বলি। man বহুবচনে men, woman women, তাহলে human কেন humen হবে না? এ প্রশ্নের উত্তর বলাবাহুল্য আমার জানা নেই তাহলে আমি humen ই লিখব, ওটাই ঠিক। জোর করলে man কে mans লিখবে।

 আর একবার উপযুক্ত বিশেষণ দিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ করতে দেওয়া হয়েছিল, teachers show us ___ path. লিখল, footpath. এ আবার কেমন কথা ফুট কি adjective? যখন path টা কি রকম বোঝাতে foot বলা হয়, তখন তো সেটা adjective ই হবে। path টা long, short, right, wrong এরকম কিছু  হবে তো।

না, না একটা path দিয়ে গাড়ি যায় সেটা দিয়ে যাওয়া মানা, হাঁটার পথ কে বলে footpath, সেখান দিয়েই সবাই যেতে পারবে।

 ইংরেজি বানান মনে রাখার জন্য আমি বুবকাকে বড় শব্দ ভেঙে ভেঙে মনে রাখতে বলতাম। যেমন together এর বানান শিখিয়েছিলাম to get her. এটা বোধহয় ওর খুব পছন্দ হয়েছিল, তাই টুগেদার দিয়ে বাক্য রচনা করতে দিলে ও লিখেছিল we play together to get her. শেষের তিনটি শব্দ যে না লিখলেই ভালো হতো, সেটা বোঝার ক্ষমতা ওইটুকু ছেলের ছিল না, আর মিস কি ভেবেছিলেন, সে কথা আমি স্বপ্নেও মনে করতে চাই না।

 বুবকার স্কুলের শিক্ষিকারা অবশ্য আমায় চিনতেন, কারণ আমি নিজেই বুবকাকে পড়াতাম। সেটা অবশ্য আমি  বাচ্চাদের টিউশন প্রথার ঘোর বিরোধী, তাই।  সে যা হোক, বুবকাকে পড়ানোর কঠিন দায়িত্ব (অথবা বাঁশ) আমি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিয়েছিলাম। বায়োলজি পরীক্ষায় ফটোসিনথেসিস কেন রাতে হয়না, এই প্রশ্নের উত্তরে যখন বুবকা লিখল, রাতে গাছেরা চোখে দেখতে পায় না, তখন আমায় শুনতে হলো, নিজের বিষয়ও ঠিকমতো পড়াতে পারি না। কিন্তু আমিতো ওকে ফটোসিন্থেসিস সংক্রান্ত অনেক কিছু পড়িয়েছি। তুই এই উত্তর লিখলি কেন, এত পড়ানোর পরে?

 এক লাইনে উত্তর লিখতে বলেছিল তো….

রাতে সূর্যের আলো থাকে না, এইতো এক লাইনের উত্তর।

 তুমি যে বলেছিলে এটা হল এক রকমের রান্না, যা দিয়ে গাছ নিজের খাবার নিজে তৈরি করে। রাতে রান্না করবে কি করে! ওদের তো ইলেকট্রিক্ আলো নেই। তাই দেখতে পায় না বলে রান্না করতে পারে না। আর ফটো মানে তো বলেছিলে আলো। সেটা সূর্যের ই হতে হবে, তার কি মানে আছে?

 এরপরেও লড়ে গেছি, হাল ছাড়িনি। ক্লাস নাইনে কি হলো বলি। লগারিদমের অংক কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আমি বললাম, ভয় না পেয়ে মন দিয়ে চেষ্টা কর। এর মধ্যে শক্ত কিছু নেই। ও বলল, এ তো লগ নয় ফগ। আমি log এর জায়গায় fog লিখব। তাই লেখ। মরা মরা বলে বাল্মিকী যদি রাম নাম উচ্চারণ করেন fog বলে তুই না হয় log শিখলি।  এত কান্ডর পরেও যখন বুবকা অংকে ১০০ তে ৪২ পেল, সিদ্ধার্থ ওকে অংকের টিউশনে ঢুকিয়ে দিল। সামনে ICSE, আর risk নেওয়া যায় না।

 এই প্রসঙ্গে বলেই ফেলি, এই ধরনের অদ্ভুত উত্তরে বুবকার সমান বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওর চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দেখান ছাত্রের অভাব ওদের স্কুলে ছিল না। একদিন আমায় বলল, মা, তুমি তো মনে করো বাংলায় আমার চেয়ে খারাপ ছাত্র হয় না। আজ সম্বুদ্ধ কি বলেছে জানো! ও বলেছে, কান্ডারী হুঁশিয়ার কবি জামরুল ইসলাম এর রচনা। আহা, বোধহয় খিদে পেয়েছিল বেচারার।

 আর একদিন ছেলে বাড়ি ফিরে হেসে গড়িয়ে পড়ে। আজ হিস্ট্রি ক্লাসে মিস ঋষির খাতা থেকে উত্তর পড়ে শুনিয়েছে। প্রশ্ন ছিল, ক্রিপস মিশন কেন ব্যর্থ হয়েছিল। ও লিখে এসেছে, it was not in the fate of Sir Stafford Cripps to become successful. অসাধারণ, বলতে বাধ্য হই।

 ICSE পাশ করার পর আমার স্বেচ্ছালব্ধ দায়িত্ব থেকে মুক্তির আশায় আত্মসমর্পণ করি, আর আমার বিদ্যায় কুলোবে না। বুবকা বহুদিন আগেই ঘোষণা করেছিল, ISC তে বায়োলজি নেবে না, কম্পিউটার নেবে। ফলে সত্যিই আমার পড়ানোর মতো কোন বিষয় ছিল না। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার পর ও মন পরিবর্তন করল। কম্পিউটার নয়, ও বায়োলজি নেবে। কারণ টিউশন এর জন্য যাতায়াত এবং নিজে পড়ার জন্য প্রচুর সময় দরকার। বায়োলজি নিলে অত কষ্ট নেই, মুখে মুখে পড়বে মায়ের কাছে।

 উঁচু ক্লাসের পড়া মুখে মুখে হয় না, বুবকা, আমি বলি, আমি বুঝিয়ে দেবো, তারপর তোকে পড়তে হবে ছবি আঁকা প্র্যাকটিস করতে হবে।

 বোঝানোর কিছু নেই, সরাসরি মুখস্থ করিয়ে দেবে, যেমন তুমি পিরিওডিক টেবিল করিয়ে দিয়েছিলে।

 সে তো মাত্র কুড়িটা এলিমেন্ট। বাকিটা তোদের সিলেবাসে ছিলনা।

 ও আমার শুনলেই হয়ে যাবে, ছেলের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

 তা কখনো হয়না। শেষে বায়োলজিতে ফেল করবি আর আমাকে শুনতে হবে আমি পড়াতে পারি না।

 পড়াশোনার শেষ কথাটাই শোনা। তাই শোনার পরে আর পড়ার দরকার নেই, কেন বুঝছ না? এতদিনে আমার বোধোদয় হলো। ঠিকই তো। কেন বলা হয় লেখাপড়া! কথাটা পড়ালেখা হওয়া উচিত, হিন্দিতে তো বলে পড়ালিখা। আর পড়াশোনা টাও ঠিক কথা নয়, বলা উচিত শোনা পড়া। আরো সঠিকভাবে বললে দুটো শব্দ মিলিয়ে সঠিক শব্দটি হওয়া উচিত, শোনাপড়ালেখা। ১২ বছর ধরে উল্টো বুদ্ধি ছেলেকে পড়িয়ে আমার এই উল্টো উপলব্ধি শিক্ষা মহলে পেশ করলে পেটেন্ট পাওয়া যাবে কিনা ভাবছি।