বেঁচে থাকা মানে আমরণ এক রক্ত রণাঙ্গন


#

যদিও পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখা কবিতার একটি লাইনের সামান্য পরিবর্তন করে এই শিরোনামের জন্ম, এই লেখার আসল উপজীব্য, বর্তমান সময়ের সর্বাধিক আলোচিত বিষয় কোভিড-১৯। এই রোগটির দৌলতে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইমিউন সিস্টেম, ভ্যাক্সিন ইত্যাদি বহুবিধ শব্দ আলোচিত হচ্ছে। অস্পষ্ট ধারণার সঙ্গে ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ পাঠক এমন অনেক কিছু কল্পনা করে নিচ্ছেন, সত্য থেকে যার যোজন দূরত্ব। কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য  পরিবেশনের উদ্দেশ্য নিয়ে এই রচনা।

 

রণাঙ্গন : মানবশরীরের অভ্যন্তর

যে মুহূর্তে একটি মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয়, যে মুহুর্তে সে ফুসফুসে ভরে নেয় বাইরের বাতাস, সেই মুহূর্তে সে নিশ্চিত করে ফেলে মৃত্যুর পদচিহ্ন। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ এ বড় সাংঘাতিক বৈজ্ঞানিক সত্য। প্রাণিজগতের একটা বড় অংশ রয়ে গেছে আমাদের দৃষ্টি শক্তির বাইরে, কিন্তু তারা আছে আমাদেরই চারপাশে। অণুজীবের (Micro Organism) এই বিরাট জগতের অন্তর্গত অনেক জীবই প্রাণীদেহে বিশেষতঃ মানব শরীরে প্রবেশ করে অসুখ সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে। ভাইরাস এক ধরণের অণুজীব, ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ ‘বিষ’। জন্ম থেকেই মানুষকে বিভিন্ন অণুজীবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। যে পদ্ধতিতে এই লড়াই দ্বারা মানবশরীরকে সুরক্ষিত রাখা হয় তার নাম ইমিউন সিস্টেম (Immune System)। কিছু নির্দিষ্ট কোষ এবং প্রত্যঙ্গকে বিশেষ শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে এই লড়াই এর উপযোগী করে তোলা হয়। যে কোন যুদ্ধের প্রাথমিক প্রয়োজন বহিঃশত্রুকে চিহ্নিত করা। অণুজীবের কোষ এবং মানবশরীরের কোষ দুয়েরই মৌলিক উপাদান মূলতঃ এক, প্রোটিন, লিপিড এবং শর্করা। এর মধ্যে থেকে অণুজীবের প্রোটিনগুলিকে চিনে নেওয়ার শিক্ষা অর্জন করতে হয়, মানবশরীরের সেনাবাহিনীকে। জন্মসূত্রে বা জিনসূত্রে আমরা এই বহিঃশত্রুর খানিকটা আন্দাজ পাই এবং তাকে আক্রমণ করে পরাজিত করতে পারি। ইমিউন সিস্টেমের এই ক্ষমতাকে জন্মগত প্রতিরোধী ক্ষমতা বা Innate Immune System বলে। যদি শত্রু আরো বেশী শক্তিশালী হয়, তাহলে আরো শক্তিশালী অস্ত্রের প্রয়োজন হয়। বাইরের অণুজীবের প্রোটিনগুলিকে Antigen বা বহিরাগত বলে চিহ্নিত করে এই সৈন্যদল তৈরী করে মারণাস্ত্র যার নাম Antibody। প্রতিরোধ ক্ষমতার এই অংশটিকে বলা হয় শিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিরোধী ক্ষমতা বা Acquired Immunity System। এই শিক্ষিত সৈন্যের রণকৌশলের একটি বিশেষ উপায় হল এরা Memory cell তৈরী করে পুরোনো শত্রুকে চিনে রাখে। শত্রু যদি আবার আক্রমণ করে, সে সহজেই তাকে ধ্বংস করতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য চারধরণের করোনাভাইরাসের কথা মানুষের জানা ছিল যাদের নাম হিউম্যান করেনা ভাইরাস বা h- Cov. কিন্তু ২০১৯ সালে যে করোনা ভাইরাস বিশ্বে মহামারী সৃষ্টি করল, সেটির কথা আগে জানা ছিল না। তাই এটির নাম দেওয়া হয় নভেল করোনা ভাইরাস বা n- Cov।

 

রণাঙ্গণ : ল্যাবরেটরীতে খোদকারি

কিছু কিছু অণুজীবের সঙ্গে এই লড়াই এ মানুষ বেঁচে গেলেও কোন কোন অণুজীব মানুষের শরীরে অপূরণীয় ক্ষতি করে, অনেক সময় মৃত্যুও অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাই মানুষ চেষ্টা করে কৃত্রিম উপায়ে মানবশরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির। আবিষ্কার করে Vaccine  বা টীকা। ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনারের গুটিবসন্তের টীকা আবিষ্কারের মাধ্যমে এই জয়যাত্রার শুরু। অণুজীবের যে প্রোটিনটি অসুখ সৃষ্টিতে সক্ষম, সেটির অসুখ সৃষ্টির ক্ষমতাকে নির্মূল করা হয় পরীক্ষাগারে, কিন্তু সেটিকে মেরে ফেলা হয় না। এই অণুজীবটির অসুখের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরীর ক্ষমতাটিকে অটুট রাখা হয়। এই ধরণের ভ্যাকসিনকে বলে লাইভ অ্যাটেনিউটেড (Live Attenuated, জীবিত ও ক্ষীণ ক্ষমতা সম্পন্ন) ভ্যাক্সিন। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে অণুজীবটিকে মেরে ফেলা হয়, এবং তার কোষটিকে মানবশরীরে ঢোকানো হয। এই ধরণের ভ্যাক্সিনকে বলে Killed Vaccine। এটির কর্মক্ষমতা প্রথমটির তুলনায় কম।

এছাড়া সম্পূর্ণ অণুজীবটির বদলে এর বিভিন্ন অংশ যেমন কোন বিশেষ সাবইউনিট বা পেপটাইড বা শর্করাকে ব্যবহার করা হয়, অণুজীবটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরীর জন্য।

আর এক ধরণের ভ্যাকসিন হল টক্সয়েড। এক্ষেত্রে ঠিক অণুজীবটির বিরুদ্ধে নয়, অণুজীবটির ক্ষতিকর অংশ (Toxin) এর বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলেই হবে না, একটি সফল ভ্যাক্সিনের প্রয়োগগত কিছু সুবিধাবলী থাকা আবশ্যিক। যেমন ভ্যাক্সিনটির প্রতিরোধ ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদী এবং সর্বস্তরের মানুষের ব্যবহারের উপযোগী হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া এটিকে হতে হবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। এটির প্রয়োগ পদ্ধতি সুবিধেজনক হতে হবে যাতে স্বাস্থ্যকর্মী রা সহজে এটি প্রয়োগ করতে পারে। তাছাড়া এই ভ্যাক্সিন সংরক্ষণের জন্য অতিরিক্ত সরঞ্জামের প্রয়োজন না হলেই ভালো। একমাত্র তা হলেই এটির বিক্রয় মূল্য সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা সম্ভবপর।

 

রণাঙ্গন : সময়

 বলাই বাহুল্য যে এত গুণ সম্পন্ন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার খুব সহজসাধ্য নয়। মহামারীর প্ররিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তি কৌশলগত সমস্যা ছাড়া আর একটি বড় সমস্যা হল, সময়। ভ্যাক্সিন মানুষের আভ্যন্তরীন প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই কাজ করে, কিন্তু বিভিন্ন মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা আলাদা। ফলে এমন একটা মাপ (dose) নির্ধারণ করতে হয়, যা অধিকাংশ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

তাছাড়া ভাইরাসের ক্ষমতা হ্রাস করে তাকে মানবশরীরে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার কাজটিও কম সময়ে হয় না। একটি ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকরক সংস্থা কোভিড মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে সময় সংক্ষেপ করার জন্য সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে ভ্যাক্সিন তৈরীতে ব্রতী হয়েছে। এক্ষেত্র ভ্যাক্সিনটি হল RNA ভ্যাক্সিন, যা দেওয়া হবে মাইক্রো নিডল অ্যারে (micro needle array) পদ্ধতিতে। সংস্থাটির দাবী, এর সংরক্ষণ ক্ষমতা বিপুল এবং এটি সহজে নষ্ট হয় না।

ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের জন্য সময় প্রয়োজন হয় আর একটি কারণে। প্রাথমিক ভাবে প্রাণীদেহে (animal model) ভ্যাক্সিনটির পরীক্ষা করে (Preclinical trial) নিশ্চিত হতে হয় যে এটি মানবশরীরে ব্যবহারের উপযোগী। এর পর ভ্যাক্সিনটির মানবশরীরে কার্যকারিতা এবং কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিনা বোঝার জন্য তাকে ত্রিস্তরীয় পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যার নাম ক্লিনিকাল ট্রায়াল (Clinical Trial)।  প্রথমে কিছু স্বেচ্ছাসেবীর (human Volunteer, কয়েক ডজন) শরীরে ভ্যাক্সিনটির পরীক্ষা চলে (Phase1)। দ্বিতীয় ধাপে আরো বেশী সংখ্যক (কয়েক শত) মানবশরীরে পরীক্ষাটি করা হয়। বিভিন্ন বয়স এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে এটির কার্যকারিতা এবং কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না সেটা দেখাই এই ধাপের লক্ষ্য। এরপর শুরু হয় তৃতীয় ধাপ, যেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরো বিশদ ভাবে পরীক্ষাটি করা হয়। এই পরীক্ষাপদ্ধতির নাম Placebo Controlled double blind randomised trial। যে সব মানুষের ওপর পরীক্ষাটি হবে তাদের অর্ধেক মানুষকে প্রস্তাবিত টীকা টি দেওয়া হয় এবং বাকী অর্ধেককে একই ভাবে কোন রোগীতোষ ওষুধ বা Placebo দেওয়া হয়। কাকে কি দেওয়া হল, রোগী বা পরীক্ষক কেউই জানল না। পরীক্ষার ফলাফলকে রাশিবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে হিসাব করে দেখাতে হয় ভ্যাক্সিনটি মানবশরীরে ব্যবহারের কতটা উপযোগী। এর জন্য ন্যূনতম ৫ বছর সময় প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে এটি দশ বছর বা তার বেশী হওয়াও আশ্চর্য্য নয়। সময় সংক্ষেপ করার দৌড়ে কোভিড ভ্যাক্সিন পরীক্ষার প্রতিটি ধাপের সময়সীমা কে ছাড় দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ ধাপ, যেখানে ভ্যাক্সিনের দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা উচিত, সেই ধাপের কথা এখনো কিছু জানানো হয় নি। এই ভাবে ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে কোভিড ভ্যাক্সিন বাজারে আসতে পারে বলে ঘোষিত হয়েছে। কোন কোন ভ্যাক্সিন প্রস্তুত কারক সংস্থা আরো কম সময় দাবী করেছেন।

একথা সত্য যে বর্তমানে কোভিডের কোন সর্বজনগ্রাহ্য চিকিৎসা নেই, ভ্যাক্সিন ছাড়া এই মহামারী ঠেকানো সম্ভব নয়। কিন্তু কার্যকরী নয়, এমন ভ্যাক্সিন পেয়ে সত্যিই কি কোন লাভ আছে! আর যদি এমন হয়, ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে? সে কিন্তু অসম্ভব নয়।

 

রণাঙ্গন : আদিম অন্ধকার

অবশ্যই বুঝতে হবে ভ্যাক্সিন মানে আলাদিনের জিন নয়। ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় Paralysis এর মতো দীর্ঘস্থায়ী অসুখ থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুই হতে পারে। ভ্যাক্সিন পরীক্ষার অতীত ইতিহাস আমাদের সেই কথাই বলে। তাছাড়া কোভিড-১৯ রোগটি সম্বন্ধে বহু তথ্যই এখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ বা অজানা।

মনুষ্যেতর প্রাণির ওপর পরীক্ষাতে দেখা গেছে ভ্যাক্সিনটি প্রাণিগুলিকে মৃত্যুর প্রকোপ থেকে বাঁচালেও সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় নি। আর সংক্রমিত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাণিটির ফুসফুসের নিদারুণ ক্ষতি হয়েছে। সেটিও ভ্যাক্সিন আটকাতে পারে নি। আদৌ পারবে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর অজানা।

এই ভ্যাক্সিন কতদিন পর্যন্ত কার্যকরী থাকবে? স্বাভাবিক সংক্রমণে যে অ্যান্টবডি তৈরী হয়, তার স্থায়িত্ব তিন মাস। ভ্যাক্সিন কি দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দেবে?

কোভিড ১৯ একটি RNA ভাইরাস যা দ্রুত জিন পরিবর্তন (mutation) করতে পারে। আজ পর্যন্ত এই ভাইরাসের ২০০টি প্রকারভেদ (strain) পাওয়া গেছে। একই ভ্যাক্সিন কি সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকরী হবে?

বয়স্ক মানুষ যাদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ খুবই বিপজ্জনক অসুখ, তাদের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক দিয়ে কোন লাভ হবে কি!

দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ছেড়েই দিলাম, অস্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে (Abnormal hyper immune response) ভ্যাক্সিনটি কোন ক্ষতি করবে না তো?

তাড়াহুড়ো করে, দিনক্ষণ পূর্বনির্দিষ্ট করে ভ্যাক্সিন বাজারজাত করা যে নিতান্ত অসম্ভব  ও অস্বাভাবিক, সেকথা বলাই বাহুল্য । রাজনীতি ও অর্থনীতির জটিল রসায়ন যখন বিজ্ঞানকে চালনা করে, তখন বিজ্ঞান তার লক্ষ্যপূরণে সমর্থ হতে পারে কি না, এই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে সংশয় ও অপেক্ষার যুগলবন্দী নিয়েই তো রণাঙ্গনে বেঁচে থাকা।

কৃতজ্ঞতা

১. গোভ্যাক্সিন থেকে কো ভ্যাক্সিন: ডা. সিদ্ধার্থ গুপ্ত

২. বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেট

৩. Placebo র বঙ্গানুবাদ রোগীতোষ প্রচলিত না হলেও সর্বার্থে সঠিক, উদ্ভাবক, ডা. পার্থসারথি গুপ্ত

৪. বন্ধুবর সন্দীপ মল্লিক, যাকে ছাড়া কম্পুটারের কাজে আ মি অচল