বিদ্যাসাগর ও বেথুন সাহেবের স্কুল
#bethune #vidyasagar
বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যে স্কুল বা পাঠশালার শিক্ষা কখনোই সেভাবে প্রচলিত ছিল না| মেয়েদেরও যে কিঞ্চিদধিক বিদ্যাশিক্ষা প্রয়োজন এ কথা প্রথম বলেন Young Bengal গোষ্ঠী| তাঁদের প্রচেষ্টায় মেয়েদের গৃহশিক্ষায় একটু মনোযোগ দেওয়া হল আর, এই প্রথম, ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেয়েদের জন্য স্কুল তৈরী হল — খাস কলকাতায় নয়, কলকাতার আশেপাশে, উত্তরপাড়া, বারাসত ইত্যাদি স্থানে| এ হেন সময়ে বেথুন সাহেব এদেশে এলেন| উচ্চবর্ণের হিন্দু মেয়েদের দুর্দশা দেখে বিচলিত বেথুন ১৮৪৯ সালের ৭ই মে ১১টি বালিকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু ফিমেল স্কুল| সম্ভবত এই প্রথম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হযে পড়লেন| তিনি কলকাতার বাইরের স্কুলগুলির কথা জানতেন, কিন্তু তাদের পরিচালনা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না|
বেথুনের কলকাতায় আসার আগে থেকেই বিদ্যাসাগর শিক্ষা ও স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে ভালোমন্দ নানান অভিজ্ঞতা আহরণ করেছেন| ব্রিটিশ সরকারও শিক্ষা ব্যাপারে তাঁর নানান পরামর্শ নেন| বেথুন কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন| দুজনেরই উদ্দেশ্য ও চিন্তাভাবনা একই, অন্তরঙ্গ পরিচয় ও বন্ধুত্ব হতে দেরী হল না| বেথুনের অনুরোধে ১৮৫০ সালের ডিসেম্বরে বিদ্যাসাগর স্কুলের সঙ্গে অনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হলেন| ১৮৫১ সালের ১২ই অগাস্ট বেথুনের অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে তাঁর স্কুল বাঁচিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব যাঁরা গ্রহণ করেন বিদ্যাসাগর ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য|
বেথুন স্কুলের একটি ঢাকা গাড়ি ছিল, ঘোড়ায় টানা| ছোট মেয়েদের বাড়ি থেকে স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য এই গাড়িটি ব্যবহার হত| তার গায়ে বিদ্যাসাগর লিখে দিয়েছিলেন কঠোপনিষদের একটি উক্তি, কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ| যদি এই শাস্ত্রবচনে সাধারণ লোকের জ্ঞান হয়! তা যারা জেগে নিদ্রাগত, তাদের তো ঘুম ভাঙানো যায় না| মেয়েদের স্কুলে পড়তে পাঠানো নিয়ে কলকাতার সমাজে দ্বিধা ছিল গগনচুম্বী| বাড়ির বাইরে পা দেওয়া মাত্রই মেয়েদের যাবতীয় নারীসুলভ গুণের হানি ঘটবে কি না, সনাতন হিন্দুধর্মের বাইরে তাদের কোনো অশিক্ষা-কুশিক্ষা দেওয়া হবে কি না, শিক্ষয়িত্রীদের জাত কি, ইত্যাদি বিচিত্র কুতর্কে শহর কলকাতা সরগরম থাকত| বিদ্যাসাগরের মত দু-একজন এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে শক্ত হয়ে না দাঁড়ালে, তিরিশ বছরের মধ্যে কলেজ তৈরী দূরের কথা, বেথুন স্কুল দশ বছরও বাঁচত কি না সন্দেহ|
এখানে আর একটা কথাও পরিস্কার করে বলা দরকার| মেয়েদের যে সম্পূর্ণ মূর্খ করে না রেখে কিছু লেখাপড়া শেখানোর দরকার আছে, একথা শহর কলকাতার বিদ্বজ্জনেরা অস্বীকার করতেন না| কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে অপরিচিত শিক্ষয়িত্রীর কাছে সুকুমারমতি বালিকাদের পাঠাতে প্রস্তুত ছিলেন না| যে সংস্কারের বোরখায় তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা থাকে, তার কোনো ছিদ্র দিয়ে যদি বাইরের আলো বা বদলের হাওয়া মেয়েদের দেহে বা মনে পৌঁছে যায়! কলকাতা শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারে গৃহের গন্ডির মধ্যে শিশুকন্যাকে কিছু লেখাপড়া শেখানোতে তাঁদের নৈতিক আপত্তি ছিল না — কিন্তু প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে? নৈব নৈব চ|
১৮৫৬ সালে বাংলার ছোটলাট Sir Cecil Beadon-এর সভাপতিত্বে যখন বেথুন স্কুলের নতুন পরিচালক সমিতি গঠিত হল, তখন বিদ্যাসাগর হলেন তার অবৈতনিক সম্পাদক| বেথুন স্কুলের দেখাদেখি তিনি মেয়েদের জন্য বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি মডেল স্কুল তৈরী করেন, কিন্তু এগুলি নিয়ে তাঁকে পরে বিপদেও পড়তে হয়| যে সরকারি সাহায্যের আশা তিনি করেছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত আসেনি| বেথুন স্কুলের জন্য যে অর্থব্যয়ে সরকার রাজি ছিল, সাধারণভাবে স্ত্রীশিক্ষায় তারা সেরকম উৎ্সাহী ছিল না| তাছাড়া সময়টা খারাপ, সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা দেখা দিচ্ছে| বালিকাদের অন্যান্য স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও বা নতুন স্কুল খোলার সময় নানান বিঘ্ন ঘটলেও, ১৮৬২ সালে বিদ্যাসাগর যে রিপোর্ট সরকার বাহাদুরকে জমা দেন, তাতে প্রমাণ হয় যে বেথুন স্কুল ভালো ভাবেই চলছিল| তিনি লেখেন, “শিক্ষনীয় বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লিখন-পঠন, পাটীগণিত, জীবন-চরিত, ভূগোল, বাংলার ইতিহাস, নানা বিষয়ে মৌখিক পাঠ এবং সেলাইয়ের কাজ| .... একজন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী, দুজন সহকারী-শিক্ষয়িত্রী এবং দুজন পন্ডিত, এই পাঁচজন হলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক| ... ১৮৫৯ সাল থেকে বিদ্যালয়ের ছাত্রীসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে কমিটি মনে করেন, যাঁদের উপকারের জন্য বিদ্যালয়টি প্রথম স্থাপিত হয়েছিল, সমাজের সেই শ্রেণীর লোকের কাছে তা ক্রমেই সমাদরলাভ করেছে|” মধ্যবিত্ত সমাজ তো তখনও কলকাতায় ঠিক তৈরী হয়নি, কিন্তু সেই সমাজের মেয়েদের জন্যই বেথুন স্কুল তৈরী হয়েছিল|
মহিলা শিক্ষয়িত্রীর অভাব ছিল খুবই — গৃহশিক্ষা এবং বিদ্যালয় শিক্ষা উভয়তই| কে পড়াবে ছোট মেয়েদের? হিন্দু হতে হবে, মহিলা হতে হবে, উচ্চবংশীয় অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ হতে হবে, বাড়ি থেকে বেরনোর জন্যে অভিভাবকদের সম্মতি থাকতে হবে এবং শিক্ষিত হতে হবে| এমন সর্বগুণসম্পন্ন মহিলা তো তখন কলকাতা শহরে দুষ্প্রাপ্য| মহিলা শিক্ষিকা তৈরী করার জন্য দু-একটি নর্মাল স্কুল সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে| স্বনামধন্য ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ মেরী কার্পেন্টার ১৮৬৬ সালে দ্বিতীয়বার ভারতে আসেন| তাঁর প্রস্তাব ছিল বেথুন স্কুলেও একটি নর্মাল স্কুল স্থাপনা করা| সম্ভবতএই প্রথম বিদ্যাসাগর মহাশয় মেয়েদের লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে গররাজি হলেন| এমন নয় যে বিদ্যাসাগর হঠাৎ স্ত্রীশিক্ষা বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন, বা বেথুন স্কুলের উন্নতি সম্পর্কে তিনি অনাগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন| সেই সময়ে কলকাতা কেন সমস্ত বাংলাদেশেই শিক্ষাব্যাপারে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমান অভিজ্ঞতা কারোর ছিল না| সেই জন্য তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বয়স্ক মেয়েদের বাড়ির বাইরে এনে লেখাপড়া শেখানোর সময় এখনও আসেনি| এর আগে বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন পর্ব চুকে গেছে, বিদ্যাসাগর মোক্ষমভাবে জেনে গিয়েছেন বাঙালি ভদ্রলোকের কার কথার কত দাম এবং বাড়ির মেয়েদের শিক্ষাব্যাপারে বক্তব্য আর কাজে তাঁদের কতটা ফারাক! ১৮৬৭ সালে বাংলার ছোটলাটকে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমাদের সমাজে যে বর্তমান অবস্থা এবং দেশবাসীর যে মনোভাব তাতে এই ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়| ... যে কাজ বা পরিকল্পনা বাস্তবে সফল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই তা আমি কোনমতেই সরকারকে গ্রহণ করতে পরামর্শ দিতে পারি না| ... এদেশের ভদ্র পরিবারের হিন্দুরা যখন অবরোধপ্রথার গোঁড়ামির জন্য দশ এগারো বছরের বিবাহিত বালিকাদেরই গৃহের বাইরে যেতে দেয় না, তখন তারা যে বয়স্ক মহিলাদের শিক্ষয়িত্রীর কাজ গ্রহণ করতে সম্মতি দেবে, এ আশা দুরাশা মাত্র| বাকি থাকে অসহায় অনাথা বিধবারা, এবং তাদেরই একাজে পাওয়া যেতে পারে| ... আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে অন্তঃপুর ছেড়ে বাইরে বিধবারা যদি সাধারণ শিক্ষয়িত্রীর কাজে যোগ দেয়, তাহলে লোকের কাছে তারা অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠবে”|
বিদ্যাসাগরের চিঠি উপেক্ষা করেই বেথুন স্কুলে স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় কাজ শুরু করল| যে কমিটির সম্পাদক ছিলেন বিদ্যাসাগর, সে কমিটি ভেঙে দেওয়া হল| বিদ্যাসাগর সব কাগজপত্র তৎকালীন স্কুল ইন্সপেক্টর Henry Woodrow সাহেবকে বুঝিয়ে দিলেন| বেথুন স্কুলের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সরকারি সম্পর্কের এখানেই ইতি| বলে রাখা ভালো তিন বছর পরে এই নর্মাল স্কুলটি বন্ধ করে দিতে হয়| বিদ্যাসাগরের যে যে কারণে আপত্তি করেছিলেন কার্যক্ষেত্রে তার প্রত্যেকটি কথাই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল|
বেথুন সাহেব, বেথুন স্কুল আর তার ছাত্রীরা বিদ্যাসাগরের মনের একটা নরম অংশ সবসময়েই অধিকার করে থাকত| যে সময়ে নর্মাল স্কুল নিয়ে নানারকম বাক্-বিতন্ডা চলছে, তার কয়েক বছর পরেই চন্দ্রমুখী আর কাদম্বিনী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিলেন, গ্রাজুয়েট হলেন, চন্দ্রমুখী প্রথম এম, এ পাশ করলেন ১৮৮৪ সালে| বিদ্যাসাগর খুব খুশী হয়ে চন্দ্রমুখীকে এক সেট শেক্সপিয়রের গ্রন্থাবলী উপহার দিলেন| সঙ্গে চিঠি লিখলেন,
“বতেস চন্দ্রমুখি –
তুমি সুস্থ শরীরে দীর্ঘজীবিনী হইয়া সুখে কাল-হরণ কর, এবং স্বজনবর্গের আনন্দদায়িনী ও সজ্জনসমাজে প্রতিষ্ঠাভাজন হও, এই আমার আন্তরিক অভিলাষ ও ঐকান্তিক প্রার্থনা”
মারা যাবার এক বছর আগে বিদ্যাসাগর কোনো এক ব্যক্তিগত কাজে বেথুন স্কুলে গেছিলেন| তাঁর জীবনীকার চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, বিদ্যাসাগর “বালিকা ও শিক্ষয়িত্রীদিগকে দেখিয়া আনন্দে অশ্রুমোচন করিয়াছিলেন| ... স্কুলের দালানে বেথুনের প্রস্তরমূর্তির সমক্ষে দন্ডায়মান হইয়া বহুক্ষণ অশ্রুপাত করিলেন”| পরে তিনি এই বলে দুঃখ করেছিলেন যে, “এতগুলি মেয়ে লেখাপড়া শিখিতেছে, তারাই আবার সেই স্কুলে শিক্ষয়িত্রীর কার্য করিতেছে, কিন্তু যে ব্যক্তি ইহার জন্য প্রাণপাত করিয়াছিল, সে দেখিল না”|
২৯শে জুলাই ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগর মারা যাবার এক সপ্তাহ পরে বেথুন স্কুলের হল ঘরে খুব বড় করে বিদ্যাসাগরের একটি স্মরণ সভা করা হয়| প্রায় ৩০০ জন হিন্দু, ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টান মহিলা সেই সভায় যোগদান করেন| চন্দ্রমুখী তখন বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা, এবং বিদ্যাসাগরের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধাবান হওয়া সত্বেও তিনি সেই সভা পরিচালনার ভার দেন কামিনী সেনকে| এই সভায় স্থির হয় যে বিদ্যাসাগরের নামে একটি তহবিল তৈরী করে বেথুন স্কুলের কোনো এক জন ছাত্রীকে Entrance পরীক্ষায় উৎসাহ দেবার জন্য দুবছর ধরে অর্থসাহায্য করা হবে|
বিদ্যাসাগর নিজে বিশ্বাস করতেন বিধবা-বিবাহ প্রচলন তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম| সেই সময়ে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র খুঁজে বিদেশী শাসককে নিজের মতে এনে, বার বার প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হয়েও হাল ছেড়ে না দিয়ে বিদ্যাসাগর যে পরিবর্তনের কান্ডারী ছিলেন, তার দ্বিতীয় উদাহরণ আর নেই| তবুও আজ দুশ বছর পরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষ করে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষত্রে, বিদ্যাসাগরের কর্মকান্ডই সম্ভবত কালজয়ী, যা আজও প্রতিটি শিক্ষিত মেয়ের জীবনকে প্রভাবিত করছে|
তথ্যসূত্র:
১| বিদ্যাসাগর: চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২| বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ: বিনয় ঘোষ
৩| চন্দ্রমুখী বসু - নতুন যুগের ভোরে: সুনন্দা ঘোষ, শ্যামলী সরকার
Comments
Vidyasagar
খুব ভালো লাগল পড়ে । তথ্যবহুল লেখা। অনেক নতুন কথা জানলাম।
Arunima
27-09-2020 08:31:55
Reply here
Vidyasagar
বেথুন স্কুলের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্কের বিষয়টি সম্পূর্ণ অজানা ছিল। ভালো লাগলো।
Soma Gupta
25-09-2020 19:21:58