ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী


#dobson #joel #americanexperience

একটা দেশকে কি করে চেনা যায়? তার মানুষদের দিয়েই তো? তাহলে কোনটা আমার দেশ? যে ১১ কোটি লোক শাহী স্নানে প্রয়াগে যায়, তারা আমার দেশ? যে মহিলা চন্দ্রায়নের সমস্ত পরিকল্পনা করেন, তিনি আমার দেশ? যে বাঙালী বাবা-মা ছেলেকে বাংলা না পড়িয়ে হিন্দী পড়ান যাতে ছেলে পরীক্ষায় অনেক নম্বর পায়, তারা আমার দেশ? ৫০০০ কোটি টাকা খরচ করে যারা ছেলের বিয়ে দেয়, সেই আম্বানী পরিবার আমার দেশ? না কি যে ছেলেমেয়েগুলি অত্যন্ত সীমীত সাধ্যের মধ্যে পড়াশোনা করে, কলেজের মধ্যে প্রথম হয়, চাকরি করে নিজেকে আর নিজের ভাইবোনকে দারিদ্র থেকে তুলে আনে, তারা আমার দেশ? পঞ্চাশ বছর ভারতবর্ষে থেকেও এ দেশকে পুরো চিনলাম না। আর আমেরিকায় ছিলাম মেরেকেটে মাত্র দশ বছর, তাহলে সে দেশকে চিনব কেমন করে?

আমেরিকা যাবার আগে আমেরিকা সম্বন্ধে কতটুকু জানতাম? আমাদের সময় স্কুলে ভারতবর্ষের ইতিহাস আর ভারতবর্ষের ভূগোল পড়ানোর ওপরেই জোর দেওয়া হত। পৃথিবীর ভূগোল আর ইতিহাস জানতে চাইলে নিজেদের মত পড়ে নিতে হত। সে ইচ্ছে আমার হয়নি, ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়েই ব্যতিব্যস্ত ছিলাম। সুতরাং আমেরিকার সঙ্গে পরিচয় গল্পের বই, অর্থাৎ থ্রিলারের মাধ্যমে। Arthur Hailey-র Hotel পড়ে New Orleans শহরের সঙ্গে পরিচয়, Airport পড়ে শিকাগোর সঙ্গে। বাড়িতে Span পত্রিকা আসত। ১৯৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কিছু নাম জানতে পারলাম – George Washington, Abraham Lincoln, Jack and Jackie Kennedy। কিছু ছবি দেখলাম – তার মধ্যে ফিলাডেলফিয়ার ফাটা ঘন্টার ছবিও ছিল। দুই মামা থাকেন আমেরিকায়, তাই আবছা আবছা Berkeley, Ames, Iowa, Minneapolis, Minnesota ইত্যাদি নামগুলো কানে আসত। আর জানতাম Grand Canyon আর Old Faithful Geyser-এর কথা। একটা ছবিওলা বই ছিল - General Knowledge for Children। New York যে আমেরিকার রাজধানী নয়, এ আমি বেশ বড় হয়ে জেনেছিলাম।

Tom Sawyer পড়েছিলাম ছোটবেলাতেই। মিসিসিপি নদীর নাম শোনা ছিল।

ম্যাপে যে সব পাহাড় জানি, জানি যে সব গাঙ

কুয়েনলুন আর মিসিসিপি, ইয়াংসিকিয়াঙ –

জানার সঙ্গে আধেক জানা, .........

ওই আধেক জানাটাই ছিল আসল! ভাবতাম সেখানে ১৮ বছর বয়স হলেই ছেলেমেয়েরা স্বাধীন আর স্বাবলম্বী হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, বাবা-মার সঙ্গে আর তাদের কোনো যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে। আমেরিকার পুরোটা যে metropolis নয়, সেখানে যে Western সিনেমায় দেখা Cowboy-রা ছাড়াও সাধারণ লোক থাকে, সব মহিলা আর পুরুষ দেখা হলেই একসঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে পড়ে না, তাদের পারিবারিক মূল্যবোধ আমাদের চেয়ে কিছু আলাদা হতে পারে, তা বলে মানুষে মানুষে ভালোবাসার, আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা তাদেরও কিছু কম নয়, একথা ওদেশে না গেলে কখনোই জানতে পারতাম না।

Joel Dobson আর অয়ন রুমমেট ছিল মাত্র পাঁচ মাসের জন্য, কিন্তু Joel-এর মা আর বাবা, Lois আর Bernard (Bud) Dobson-এর কাছে সারা জীবনের জন্য কেমন করে যেন আমরা ভালবাসার মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম।

Dobsons - Joel, Lois and Bud

 

অয়ন ১৯৮৬ সালে Penn State-এ গেল Statistics-এ PhD করতে। আমার শাশুড়ীর এক প্রাক্তন ছাত্র দেবাশিস তখন Penn State-এ, Economics-এ Masters করছে। সে থাকত McKee Hall-এ, Penn State-এর Graduate Student-দের একমাত্র হস্টেল, ওদেশে বলত dormitory। তার পরামর্শে অয়নও McKee Hall-এ আশ্রয় নিল। পরামর্শটা ঠিক ছিল না, কারণ McKee Hall-এ থাকতে হলে ওদের cafeteria-তেই খেতে হবে। তার জন্য আলাদা খরচ। খাবার ভালো, কিন্তু বেশ দামী। এদিকে McKee Hall-এ কোনো রকম রান্না করা একেবারেই বারণ। পরে বোঝা গেছিল দেবাশিসের কোনো পরামর্শতেই ঠিক কান দেওয়া চলে না। তার চেহারা ছোটখাটো, জামাকাপড়ের সাইজ small না হলেও medium, কিন্তু পরত একটা XXL সাইজের কোট। কেননা দোকানে গিয়ে দেখেছিল ওই কোটের দামই সবচেয়ে কম! দেবাশিস হাঁটলে কোটটা বরফ ঝাঁট দিতে দিতে যেত।

একটা সেমেস্টার দেবাশিস আর অয়ন রুমমেট ছিল। তারপর দেবাশিস Masters করে চলে গেল, অয়নের রুমমেট হয়ে এল Joel Dobson। Joel-এর বাড়ি State College থেকে একশ মাইল পশ্চিমে Coolspring নামে একটা গ্রামে। Joel ফিজিক্সে Masters করছে, ওর ও এটাই প্রথম বছর। সুন্দর চেহারা, সুন্দর ব্যবহার, বুদ্ধিমান ভদ্র ছেলে। McKee Hall-এ প্রতি ঘরে একটা করে ফোন, ল্যান্ডলাইন। একজনের ফোন এলে অন্যজন ধরে, কথাও শোনে। বাংলা কথা তো আর Joel বুঝত না, কিন্তু কি রকম করে যেন ‘আচ্ছা’ কথাটা তার খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকান উচ্চারণে বলত ‘আআচা’। একবার New York থেকে রুমা যখন ফোন করেছে, অয়নের বদলে Joel কি সব কথার পিঠে বার দুয়েক উত্তর দিয়েছে, “আআচা”। রুমা ভেবে নিয়েছে অয়নের রুমমেটও বাঙালী, সে তো পুরোদস্তুর বাংলায় কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। তখন Joel পড়েছে বিপদে, “Hold it, hold it! I don’t know what you are talking about”।

শেষ যখন ওর সঙ্গে কথা হয়েছে, হয়ত দশ বছর আগে, তখনও বলেছে, “See Ayan, I have not forgotten it, আআচা”!

অয়ন আর Joel রুমমেট ছিল মাত্র একটা সেমেস্টার। যেহেতু বাড়ি কাছে, প্রায় প্রতি শনি-রবিবারেই Joel বাড়ি যেত। মাঝে মাঝে ওর বাবা-মাও আসতেন। Joel ছিল একমাত্র সন্তান। আমেরিকান পরিবারে সেটা বিরল ঘটনা, বিশেষ করে পেনসিলভানিয়ার গ্রামে।

আমাদের বিয়ের পরে যখন আমরা 626 South Pugh Street-এর বাড়িতে থিতু হলাম, Joel একটা রবিবার আমাদের ওর বাড়ি নিয়ে গেল। Lois আর Bud-এর সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। ১৯৮৯ সালের জুন মাস, Fathers’ Day ছিল সেটা। তার পরে বহু বার ওনাদের বাড়ি গেছি, Joel-এর সঙ্গে নয়, আমরাই গেছি, আমার বাবা-মাকে নিয়ে গেছি, শঙ্করীকে নিয়ে গেছি। হিসেব করলে দেখা যাবে, Joel-এর চেয়ে হয়ত বেশি বার ওর বাবা-মা’র সঙ্গেই আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। ২০০৮ সালের Fall-এ আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল। এখন তো একে একে দুজনেই বিদায় নিয়েছেন। Joel পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনী নিয়ে Texas-এর বাসিন্দা সেই ১৯৯০ সাল থেকেই।

Dobson-রা নিয়মিত চার্চে যেতেন, Joel-ও যেত। বাড়িতে গেলে তো বটেই, State College-এও মোটামুটি নিয়মিত চার্চে যেত। Joel-এর ভাবী সহধর্মিনী Gayla-র সঙ্গেও পরিচয় চার্চেই। অল্পবয়সীরা কেন চার্চে যায় জিজ্ঞাসা করায় Joel একবার হেসে বলেছিল,

“To date! Usually your first dates are your kid sister’s friends. Your sister always remains a kid sister, but her friends grow up. I don’t have any sister, so ...”।

সেদিন আমরাও Dobson-দের সঙ্গে ওনাদের চার্চে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে ওনারা যেতেন Methodist চার্চে। বাড়ির পাশেই। দেখলাম বাড়ি খুলে রেখেই যাওয়া হল। গ্রাম তো, দু-তিন ঘন্টা সময়ের জন্য বাড়িতে চাবি দেওযার প্রয়োজন ছিল না। Mrs. Dobson চার্চে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, “We are blessed today to have among us two of my son’s college friends Ayan and Srabashi, who come from a far country”। Pastor আমাদের স্বাগত জানালেন।

চার্চ থেকে বাড়ি এসে দুপুরের খাওয়া। তখনই টের পেলাম Mrs. Dobson একজন অসামান্য রন্ধনপটিয়সী। ওনার মত স্টেক আর হ্যাম আমি আমেরিকার নাম করা Steakhouse-এও খাইনি। টেবিলের ওপর অন্তত দশ-বারো রকম খাদ্যবস্তু ছিল। পানীয় ছিল হয়ত তিন রকম – না কোনোটাই alcoholic নয়। নানা রকম চীজ, স্যালাড, মাংস, রুটি আর অবশ্যই ডেসার্ট। জোর করে খাওয়ানোতে Lois কোনো বাঙালী মাসিমার থেকে কম ছিলেন না। আর খাবার ব্যাপারে অয়ন বা আমার কোনো চক্ষুলজ্জার বালাই কোনোদিনই নেই। মিষ্টান্নকে বিকেল অবধি ঠেলে রেখে, স্টেকের প্রতি মনোঃসংযোগ করতে আমাদের কোনো অসুবিধেই হয়নি।

Rural Pennsylvania-র সঙ্গে প্রথম পরিচয় E. B. White-এর লেখা Charlotte’s Web পড়ে। Dobson-দের ফার্ম ছিল না, দুজনেই কাছাকাছি একটা Teaching University-তে চাকরি করতেন। Mr. Dobson কাজ করতেন Electrical Department-এ, সম্ভবত Chief Electrician হয়ে রিটায়ার করেন। Mrs. Dobson ওখানেই Publication Department-এ ছিলেন। আমার কাছে central Pennsylvania-র গ্রাম বললে তিন একর জমির মধ্যে Dobson-দের ছোট্ট বাড়িটাই মনে পড়ে। বাড়ির সামনে একটা দোলনা ছিল, Bud-এর বানানো। সেখানে স্বাস্থ্যবান দুজন মানুষ আরামে বসে দুলতে পারেন।

আমেরিকার গ্রাম বা এমনকি আধা শহরের দিকে প্রচুর হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। Pennsylvania আর Texas দু জায়গাতেই দেখেছি। ব্যাপারটা একটু বিপজ্জনক। সাবধানে গাড়ি না চালালে গভীর রাতে হরিণের সাথে সংঘর্ষ হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। যাদের অল্পস্বল্প খেত-খামার আছে, তারাও বিরক্ত, হরিণ এসে সব নষ্ট করে দেয়। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া হরিণ শিকার নিষেধ। Bud-এর জমিতেও হরিণের উপদ্রব ছিল। ওনার তিনটে রাইফেল ছিল, তাই দিয়ে উনি আর Joel বাড়ি থেকেই হরিণ শিকার করতেন। আমাদের খাতিরে একটা রাইফেলে গুলি ভরে একটা চাঁদমারি বসিয়ে দিলেন জমির একদিকে। দেখিয়ে দিলেন কিভাবে রাইফেলটা কাঁধের ওপর ধরে লক্ষ্য ভেদ করতে হয়। আমি নিয়ম মেনে যা যা করবার সবই করলাম, কাঁধে একটা ধাক্কাও খেলাম, কিন্তু গুলিটা কোন দিকে যে গেল তার আর হদিশ মিলল না। এয়ারগানে বেলুন ফাটানো আর আসল রাইফেল চালানো যে এক নয়, সে সেদিনই মালুম হয়েছিল।

Shooting a rifle - the only time!

একতলা এই বাড়ি Dobson-রা বানিয়েছিলেন নিজেরা। পুরো বাড়ির তলায় প্রকান্ড বেসমেন্ট, আর ওপরে একটা অ্যাটিক। শীতের দেশ, বেসমেন্টেও হিটিং-এর ব্যবস্থা, আর এক পাশে Bud-এর carpentry-র যন্ত্রপাতি। Mr. Dobson বলেছিলেন একমাত্র plumbing ছাড়া বাড়ির আর সব কিছু কাজই ওনারা নিজেরা করেছিলেন। Lois-এর মা আর ভাইয়ের পরিবার Coolspring-এ থাকতেন। Bud-এর বাড়ি ছিল কাছাকাছি একটা গ্রামে। Lois-এর ভাই, Bud-এর ভাই আর Bud স্বহস্তে বাড়ি তৈরী করে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষের কয়েক মাস Bud সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, বোধহয় দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও পোস্টিং ছিল। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ফিরে এসে সুন্দরী Lois-কে বিয়ে করে খানিকটা জমি কিনে সংসার পাতলেন Coolspring-এ। বিয়ের সতেরো বছর পরে Joel-এর জন্ম। ওনারা নাকি হালই ছেড়ে দিয়েছিলেন!

বোঝাই যায় Lois খুব গপ্পিয়ে। না হলে এতো সাংসারিক কথা ছেলের বন্ধুদের কে বলে? প্রথম থেকেই Lois যে আমাদের কি ভালই বেসেছিলেন কি বলব। বার বার বলতেন, “ We love ya. We always think of you as our own”. Bud ছিলেন কম কথার মানুষ। আর Lois ঝুলি উজাড় করে গল্প করতেন – ওনার মা আর ভাইদের কথা, ওনার একটি ছোট বোন ছিল যে, আজকের ভাষায়, বিশেষভাবে সমর্থ। সে কাছেই একটা ইনস্টিটিউশনে থাকত। ছেলের গল্প তো করতেনই, ছেলের বৌয়ের গল্পও করতেন। বোধহয় প্রথম দিকে বৌকে অতটা পছন্দ ছিল না (সব দেশের শাশুড়িরাই কি একই রকম?)। একবার Bud বলেই ফেললেন,

“Nobody is good enough for our son!”

কিন্তু Lois বলতেন,

“We love her. She is our son’s wife, his lover, mother of our grand-children. We love’er”।

হাতের কাজে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিলেন দক্ষ কারিগর। Bud বানাতেন কাঠের জিনিস, ছোট এবং বড়। Joel-ও কাঠের কাজ করতে পারত, বাবার কাছে শিখেছিল। Joel আর Gayla-র Lubbock, Texas-এর বাড়িতে জানলার তলায় বসার সীট Joel নিজে বানিয়েছিল।  ছেলেকে আর নাতি-নাতনীকে তো Bud খেলনা বানিয়ে দিতেন বটেই, আমাদেরও বানিয়ে দিয়েছিলেন এক জোড়া কাঠের হাঁস, একজোড়া প্রজাপতি, একটা Christmas table center-piece। এক বছর অয়ন আর আমি Christmas-এর সময়ে Joel-দের কাছে ছিলাম। Bud ছেলেকে একটা ঘড়ি বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন, সঙ্গে আমাদেরও ঠিক একইরকম একটা টেবিল ঘড়ি। ঘড়িটি এখনও চমৎকার চলছে। Dobson-দের বাড়িতে একটা চরকা দেখেছিলাম, শুনেছিলাম সেটা Bud-এর মা চালাতেন, সুতো কাটতেন। শখ করে। সেটিও Bud-এর হাতে তৈরী। আর দিয়েছিলেন একটা কাঠের ক্যালেন্ডার, যা সারা জীবন ব্যবহার করা যাবে। ছোট্ট‍ ছোট্ট কাঠের চৌকো টুকরোর ওপরে 1 - 31 লেখা। পাঁচটা সমান্তরাল রেলের মধ্যে সেগুলো সাতটা করে সাজিয়ে রাখলেই ক্যালেন্ডার তৈরী। আজকে তিরিশ বছরেরও বেশী হয়ে গেল, ঠিক একই রকম আছে ক্যালেন্ডারটা।

Lois বানাতেন patchwork quilt, এবং অকাতরে বিলোতেন। আমাকে দিয়েছেন দু-দুটো ডবল বেড সাইজের, আমার মাকে দিয়েছেন একটা। প্রথম দিকে তো আমি অপ্রস্তুতের একশেষ। এতো পরিশ্রমের জিনিষ কেউ এভাবে বিলিয়ে দিতে পারে?

“Ya take it, use it in winter. It’s big and it’s warm. It’ll keep you warm!”

Lois সারা জীবনে হয়ত ষাট-সত্তরটা patchwork quilt বানিয়েছেন, তার বেশীর ভাগই আসল patchwork। বড় কাপড় থেকে ছোট ছোট সমান সাইজের বিভিন্ন শেপে কেটে, সেগুলো প্রথমে হাতে সেলাই করে প্যাটার্নটা তৈরী করতে হত, তার ভেতরের জায়গাটা ভরাট করতে হত সাদা বা অন্য কোনো রঙের কাপড় দিয়ে। এটা হল লেপের ওপরটা। তার ভেতরে থাকত একটা গরম কিছু, হয়ত ফ্লানেল বা ওই রকম কিছু। তার তলায় থাকত আর একটা সাদা কাপড়। এবার সবটা একসঙ্গে সেলাই হত, আমাদের দেশের লেপের মতন বিভিন্ন প্যাটার্নে। ব্যাপারটা বলতে একটু, কিন্তু করতে অনেক ক্ষণ। এক একটা patchwork quilt বানাতে হয়ত ছ-সাত মাস লাগত। Bud কাপড়গুলো সমান করে কেটে সেলাই করে দিতেন অনেক সময়ে। ওনাদের স্থানীয় কাগজে Lois-এর একটা ইন্টারভিউ বেরিয়েছিল। তাতে উনি খুব খুশী হয়ে বলেছিলেন যে ওনার তৈরী বেশ কয়েকটা লেপ আর আফগান ভারতবর্ষে আছে। ক্রচেটেও খুব দক্ষ ছিলেন Mrs. Dobson। একটা ক্রীম রঙের আর একটা বহুরঙার আফগান আমার কাছে আছে। তাছাড়াও ক্রচেটে গোলাপ ফুল বুনতেন।

ওনাদের বাড়িতে একটা পেট্রোল স্টেশন ছিল। যেমন রাস্তার পাশে থাকে, ঠিক তেমনি। মাটির তলায় গ্যাসের ট্যাঙ্ক, ওপরে একটা পাম্প। তবে মনে হয় Dobson-রা রিটায়ার করার পরে এই ব্যবস্থা আর চালু রাখেননি। যখন ছাত্র ছিলাম, ওনাদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় আমাদের গাড়ির ট্যাঙ্কটা অতি অবশ্যই ভরে দিতে ভুলতেন না।

আগেই বলেছি Lois-এর পরিবার Coolspring-এই থাকতেন। ওনার মাকে আমরা দেখেছি। তাঁর বাড়িতেও গেছি। হয়ত Dobson-দের বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে। Lois-এর এক ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। আসলে আমরা গেলে Dobson-রা খুব খুশী হতেন। পেট ভর্তি করে খাইয়ে-দাইয়ে আমাদের নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরতেন। কিংবা কাউকে কাউকে বলতেন ওনাদের বাড়ি আসতে। Lois-এর মা যখন আর একা বাড়িতে থাকতে পারতেন না, হয়ত বয়স হয়ে গেছিল আশীর ওপর, তখন শেষ কয়েক বছর Dobson-দের কাছে ছিলেন। হ্যাঁ, ছেলের বাড়িতে না থেকে, মেয়ে আর জামাইয়ের সঙ্গেই থাকতেন। একদম শেষ জীবন অবশ্য কাটিয়েছিলেন একটা Hospice Care বা Nursing Home-এ। Bud-এর মা ও কিছু বছর Dobson-দের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। আমেরিকার Nursing Home বলতে কিন্তু হাসপাতাল বোঝায় না। সেখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা থাকেন, নার্সরা তাঁদের সেবা যত্ন করেন। ঠিক Old-age Home নয় কিন্তু। যাঁদের nursing care দরকার, বাড়িতে সম্ভব নয় সেটা পাওয়া, তাঁরা Nursing Home-এ থাকেন। আর Hospice Care হল terminally ill রুগীদের জন্য, যে কোনো বয়সেরই হতে পারে। যাদের আর হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, চিকিৎসার বাইরে, তাদের শেষ দিনগুলো আরাম আর সেবাযত্নের জন্য Hospice Care।

Lois-এর একটি ছোট বোন ছিল। Cerebral palsy-র রুগী। শেষ পর্যন্ত তাকেও একটা Nursing Home-এ দিতে হয়েছিল। Lois আর Bud নিয়মিত তাকে দেখতে যেতেন।

 

My daughter with her American Gran-ma and Gran-pa

 

Joel চাকরি নিল Texas Instruments-এ, সারা জীবন সেখানেই ছিল। রিটায়ার করেছে দু-বছর আগে। Pennsylvania থেকে Texas অনেক দূর, প্রায় দেড় হাজার মাইল। একমাত্র ছেলের কাছে বুড়োবুড়ি যেতেন বছরে দু-তিন বার। গাড়ি চালিয়েই যেতেন। বলেছিলেন,

“We drive as much as we can every day. We stop often, every two hours or so. Spend one or two nights in a motel on our way. We like to spend as much time with our grand-children. But this is our home. We will keep this house for as long as we can”।

Joel-এর কাছে আমরা দু-বার গিয়ে কয়েক দিন করে থেকেছি। একবার ছিলাম Christmas-এর সময়ে। Gayla Lois নয়, কিন্তু বরের বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না তারও। Gayla সুন্দরী না, কিন্তু কর্মপটিয়সী। চারটি ছেলে মেয়ে মানুষ করা, দুটো কুকুর আর কয়েকটা বেড়ালের দেখাশোনা, বাগান, চার্চের কাজ, সেলাই, রান্না-বান্না – সবই তো করতে হত! Gayla-র ভাই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটা যুদ্ধ থেকে ফিরেছিলেন হুইল চেয়ার বন্দী হয়ে। ফেরার পরে পরেই তার ড়িভোর্স হয়ে যায় যখন ছেলে ছোট। Joel-এর বাড়ি বড়, চারটি ছেলে-মেয়ে। সেই বাড়ির এক দিকে খানিকটা আলাদা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল Joel আর Gayla, যাতে ভদ্রলোক কিছুদিন ছেলে নিয়ে সেখানে থাকতে পারেন, কারুর ওপর গলগ্রহ হতে না হয়, অথচ পারিবারিক সাপোর্ট পেতে পারেন। Lois আমাদের বলেছিলেন, “I told Joel always do what you can for others. It’s not hurting him, he can afford to do it”।

২০০৮ সালে শেষ দেখা Bud আর Lois-এর সঙ্গে। ওনাদের বয়স তখন আশী ছুঁই-ছুঁই। আমাদের বললেন যে বাড়িতে কিছু অদল-বদল করতে হবে, ডাইনিং টেবিলের সামনের জানলাটায় কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, জানলাটা বদলাতে হবে। দেশে ফিরে আসার আগে ফোন করেছিলাম, বললেন সে কাজটা হয়ে গেছে। ওনারা নিজেরাই করে নিয়েছেন, এই বয়সেও কোনো মিস্তিরি ডাকতে হয়নি। তখনই মনে হয়েছিল এই হয়ত Dobson-দের সঙ্গে শেষ দেখা। Bud চলে গেলেন ২০১২ সালে। ওনারা দুজনেই শেষ দু-তিন বছর একটা বৃদ্ধাশ্রমে চলে গিয়েছিলেন, যদিও বাড়িটা বিক্রি করেননি। Bud-এর ক্যান্সার হয়েছিল, একদম শেষ কয়েকটা মাস একটা Nursing Home-এ ছিলেন। Joel-এর কাছ থেকে খবর পাবার পরে আমরা Lois-এর সঙ্গে কথা বললাম। Lois তখন বাড়ি বিক্রি করে Texas-এ চলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছেন। সেই Coolspring-এর ছোট্ট বাড়িটা, যেটা স্বামী-স্ত্রী মিলে নিজের হাতে তৈরী করেছেন, নিজের হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিলেন এত বছর। বাড়ি বিক্রির কথায় আমারই মন খারাপ হয়ে গেল, Lois-এর কতটা খারাপ লাগতে পারে বুঝতেই পারছিলাম। কিন্তু দেখলাম জীবনের ভালো আর মন্দ দুটোই সহজে মেনে নেবার মত মনের জোর ওনার রয়েছে। Bud-এর কথায় বললেন, “He was suffering. I am glad his suffering days are over”।

Lois আর Bud-এর যৌথ জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। Lois একবার আমাকে বলেছিলেন, “We never go to bed angry”। এক দিনের মনোমালিন্য সে দিনই মিটিয়ে নিয়ে পরের দিন আবার নতুন করে শুরু করতেন।

তারপর তো অনেক দিনই আর Dobson-দের খবর পাইনা। সম্প্রতি আমার মামাতো ভাই কুণাল আমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করল,

“দিদি, তোমরা Joel Dobson বলে কাউকে চেন? সে আমার সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করে অয়নদার ই-মেল চাইছে। দেব কি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। যাব্বাবা, তোকে কি করে খুঁজে পেল?”

Lois চলে গেলেন ২০২৩ সালে। কিছুদিন Joel-এর সঙ্গে ছিলেন, তারপর বোধহয় একটা Nursing Home-এ। সেই খবর দেওয়ার জন্যই Joel অয়নের খোঁজ করছিল। কলকাতায় কয়েক লক্ষ বাসু পদবীধারীদের মধ্যে থেকে কেমন করে যেন সে আমারই ভাইয়ের ফেসবুক খুঁজে পেয়েছিল!

লীলা মজুমদার এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘জীবন হল নদীর মত’। এই কথাটা আমার খুব ভালো লাগে। ছোট নদীর মত চলতে চলতে জীবনের কোন বাঁকে কোন জন বসে আছে কি উপহার নিয়ে, কে জানে?