93/4 প্ল‍্যাটফর্ম এবং…..


#

“তোরা লন্ডন আসছিস? একবার কেমব্রিজ আয়, আমি ঘুরিয়ে দেখিয়ে দে”।

বন্ধুবর নন্দনের এহেন প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না। “কিভাবে যাব”?

“কেন, কিংস্ ক্রস স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠবি, কেমব্রিজ স্টেশনে নামবি, আমি স্টেশনে থাকবো”। “কিংস ক্রস স্টেশন, কোন রাজা গো?”

“রাজা চতুর্থ জর্জ” ।

“তাকে কি ক্রুসিফাই করা হয়েছিল?”

“না, না, সেই ক্রস নয়, ক্রসিং। তিনটে বড় বড় রাস্তার ক্রসিং। ইউস্টন রোড, গ্রেজ্ ইন রোড আর পেন্টোভিল রোড” । 

ভারী অপূর্ব আর দর্শনীয় স্থান এই স্টেশনটি। মাটির তলা দিয়ে রেল ছুটেছে লন্ডন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, রকমারি লাইন ধরে। সব লাইনের জন্য এটি জংশন স্টেশন। আবার মাটির উপর দিয়ে রেল ছুটেছে শহর ছাড়িয়ে দূরে, শহরতলী, নিউক্যাসেল, গ্লাসগো, এডিনবরা। চলমান সিঁড়ি দিয়ে মাটির নিচের সঙ্গে ওপরের অংশের যোগাযোগ। নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা আগেই পৌঁছে গেছি। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে টিকিট কাটা যায়, কিন্তু সেসব কারিকুরিতে না গিয়ে হাতে টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়ালাম। চটপট টিকিট কাটা হয়ে গেল। ট্রেন আসতে এখনো ঘন্টাখানেক দেরী। সকালে বের হবার তাড়ায় সিদ্ধার্থ আর বুবকার ঠিকমতো খাওয়া হয়নি, ওরা খেতে গেলো। আমি স্টেশনটা একটু ঘুরে দেখতে গেলাম। কি জানি কেন, স্টেশনে পা দিয়েই আমার মনে হচ্ছিল, এ জায়গা আমার বহুদিনের চেনা। দেখার মতোই স্থাপত্য এই স্টেশনের। পুরোনো নতুনের এক অভিনব মিশেল। পুরনো স্থাপত্যের অংশ আমায় চুম্বকের মত টানছিল। যতই এগোই মনে হয়, এখানে আমি আগেও এসেছি, বহুবার। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। আরে! এটা কি লেখা?  9 প্ল‍্যাটফর্ম ? এখানে ? তাইতো ! বইয়ে তো পড়েছি এই স্টেশনের নাম। সিনেমাতেও এই স্টেশনটা দেখিয়েছিল বোধহয়, তাই এত চেনা চেনা লাগছে। এগিয়ে গেলাম স্বপ্নের প্ল‍্যাটফর্মের দিকে।

দুটি হাসিখুশি মেয়ে এগিয়ে এলো, “যাবে নাকি হগওয়র্ট্স”?

যাব মানে? পা তো বাড়িয়েই আছি

“Which house?”

আমি নির্দ্বিধায় বললাম, “গ্রিফিনডোর” ।

 “oh, sure”, বলে একজন আমার হাতে একটা ট্রলি ধরিয়ে দিল, তাতে গাদাখানেক ট্রাংকের উপর একটা শ্বেত-শুভ্র পেঁচা। আর একজন আমার গলায় জড়িয়ে দিল গ্রিফিন ডোরের হাউস স্কার্ফ।

“Now go ahead and jump, তোমার ক্যামেরা টা আমায় দাও, ছবি তুলে রাখি” ।

চোখ বন্ধ করে ট্রাঙ্ক সমেত ধাক্কা মারলাম প্লাটফর্মের দেয়ালে। একজন বলল, “Mam, you are a real  Potter fan”.

“কি করে বুঝলে”?

“তোমার চশমাতেও দেখছি হ্যারি পটার লেখা”।

ওহো এই চশমাটা তো শখ করে বানিয়েছিলাম, নিয়মিত পরি না, মজা দেখো, আজ ই….

 এরমধ্যে ফোন আসা শুরু হয়ে গেছে। কোথায় ঘুরছ ? ট্রেনের সময় হয়ে গেল। হাসিখুশি মেয়ে দুটিকে জিজ্ঞেস করলাম কত দিতে হবে। “নাথিং”, বলে ওরা এগিয়ে দিল একটা ভিজিটরস বুক। তাতে সই করে ফিরে চললাম আমার নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের দিকে, জাদু নগরীর দরজা থেকে যা বহুদূর।

 কিন্তু সত্যিই কি তাই? কেমব্রিজ স্টেশনে নেমে নন্দনের গাড়ি চড়ে পৌঁছে গেলাম ঐতিহাসিক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। সেই ১২০৯ সালে তৃতীয় জর্জ এর রাজত্বকালে শুরু হয়েছিল এর পথ চলা। বর্তমানে এর অধীনে আছে ৩১ টি আলাদা আলাদা কলেজ।

 চমকে উঠলাম কেমব্রিজের লোগো দেখে। এও যে বড্ড চেনা। লাল পটভূমিতে চারটি সোনালী সিংহ। মাঝে একটি ক্রস, তার মাঝে একটি বই। হগওয়র্ট্স লোগোও তো প্রায় তাই। ক্রস দিয়ে চার ভাগে বিভক্ত। চারটে সিংহের বদলে একটিতে গ্রিফিনডোরের সোনালী সিংহ, বাকি তিনটে ঘরে অন্য তিন হাউজের প্রতীক, আর বইয়ের জায়গায় এইচ লেখা।

নন্দন বলে চলেছে কত স্বনামধন্য ব্যক্তির পদধূলি লাঞ্ছিত এই প্রতিষ্ঠান। ষোড়শ শতাব্দীতে এখানকার ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হয়েছেন জন মিল্টন, গনভিল কলেজে পড়াশোনা করেছেন উইলিয়াম হার্ভে (রক্ত সংবহনতন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রথম তিনি দিয়েছেন), আর ট্রিনিটি কলেজে এসেছেন আইজ্যাক নিউটন, এখানেই কোথাও বসে লিখেছেন প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা।

 পরবর্তীকালে ক্রাইস্ট কলেজে পড়াশোনা করেছেন চার্লস ডারউইন। এই কলেজেই তাঁর প্রথম প্রকৃতি প্রেম।  সুন্দর শান্ত পরিবেশে তাঁর কর্মস্থল, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ক‍্যাম নদী। এই ক্যাম নদীর নামেই কেমব্রিজের নাম। সেখানে নৌকা চলে, কখনো কখনো বাইচ প্রতিযোগিতাও হয়। সেও নাকি দেখবার মতো। সুন্দরী এবং মোহময়ী ক‍্যাম নদীর পাশে বসে থাকলে কবিতা স্বয়মাগতা হয়ে ধরা দেবে কলমের গোড়ায়। আর যদি সেখানে আসেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, স্যামুয়েল কোলরিজ অথবা লর্ড টেনিসনের মতো প্রতিভা, তবে তা পূর্ণ বিকশিত হবে, একথা বলাই বাহুল্য।

 দেখলাম ক্যাভেন্ডিশ ল্যাব। ডেভনশায়ারের  ডিউক, উইলিয়াম  ক্যাভেন্ডিশ পদার্থবিদ্যার কেন্দ্র হিসাবে তৈরি করলেন এই ল্যাব, যেখানে যোগ দিয়েছিলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্বের জগতে যাঁর অবদান অসামান্য। এখানে কাজ করেছেন জে জে থমসন, যিনি আবিষ্কার করেছেন ইলেকট্রন কণা এবং তাঁরই কাজের সূত্র ধরে পরবর্তীকালে আত্মপ্রকাশ করে টেলিফোন, রেডিও, টিভি।

 “এই যে দেখছো ঈগল পাব. এটি একটি বিখ্যাত জায়গা, কেন জানো‌”?

খুবই সাদামাটা চেহারার একটা পাব। বিশ্ব বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় খুবই সাধারণ, এটাই কি এর বিশেষত্ব ?

“মোটেও না, এখানে ওয়াটসন আর ক্রিক তাদের ডিএনএ পরমাণু গঠন আবিষ্কারের কথাটি ঘোষণা করেন । তাঁদের কর্মস্থল অবশ্য গনভিল কলেজ পুরো নাম গনভিল এন্ড কেইস কলেজ”।

আরে, ‘ডায়াগন অ্যলি’র ‘লিকি কল্ড্রন পাব’ এমনি সাদামাটা ছিল না? আর সেখানেই তো হ‍্যাগ্রিড হ্যারি পটার কে প্রথম পরিচিত করেছিল জাদু দুনিয়ার সাথে।

“এই ঘড়িটা দেখো, দেখেছো কোথাও”?

“উহুঁ”, ঘাড় নাড়ি, “পা সিনেমায় দেখিয়েছে, বিদ্যা বালানের সঙ্গে অভিষেক বচ্চনের পরিচয় এই ঘড়ির সামনে। ভালো করে দেখো, এমন অদ্ভুত ঘড়ি কোথাও নেই, এর নাম কর্পাস ক্লক, কেউ কেউ বলে গ্রাস হপার ক্লক। ২৪ ক্যারেট সোনায় তৈরি এই ঘড়ির উদ্বোধন করেন স্টিফেন হকিং ২০০৮ সালে। এই ঘড়ির কোন কাঁটা নেই, ফড়িং জাতীয় এক অদ্ভুত জীব (যার থেকে নাম হয়েছে গ্রাস হপার ক্লক) ক্রমাগত সময়কে খেয়ে চলেছে। তাই এর ডাকনাম টাইম ইটার, chronophage নামেও এর পরিচিতি”।

ডাম্বলডোরেরও একটা অদ্ভুত দর্শন সোনার ঘড়ি ছিল, মনে মনে বলি। তাতে অবশ্য বারোটা কাঁটা ছিল আর পরিধিতে ছিল অনবরত ঘূর্ণায়মান ছোট ছোট গ্রহ।

নাঃ, আজ দেখছি আমায় হগোয়ার্টস্ পেয়েছে। আর হবে নাই বা কেন। জাদু নগরী তো থাকে আমাদের মনে। আর তার প্রবেশমুখ আমাদের মাথায়। 

কত যাদুকরের যাদুমন্ত্রে কেমব্রিজের ঝুলি ভরে উঠেছে একশ কুড়িটা নোবেল প্রাইজে। আর কি সব যুগান্তকারী কাজ! লরেন্স ব্র‍্যাগ কাজ করছেন X-ray diffraction এর ওপর, ফ্রেডেরিক হকিন্স আবিষ্কার করছেন ভিটামিন, রাদারফোর্ড ভেঙ্গে ফেলছেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস, কাজ হয়েছে কৃত্রিমভাবে প্রজনন পদ্ধতির উপর (রবার্ট এডওয়ার্ডস), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর (অ্যলান টুরিং), জনসংখ্যা তত্ত্বের ওপর (থমাস ম‍্যালথাস) আর অবশ্যই উল্লেখযোগ্য এখানকার মহাকাশ চর্চা।

ট্রিনিটি কলেজে পিএইচডি করতে এলেন স্টিফেন হকিং, রয়ে গেলেন অধ্যাপক হিসেবে, লিখে ফেললেন সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। তাঁর নিজস্ব সময় তো সংক্ষিপ্তই হবার কথা। দুরারোগ্য মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন তিনি, কিন্তু কোন যাদু বলে সময়কে থমকে দিয়েছিলেন। হারমিওনির টাইম টার্নার নিশ্চয়ই ছিল তাঁর কাছে।

খুব করে চাইলে সর্টিং হ‍্যাট যেমন সেই চাওয়াকে মর্যাদা দেয়, আমার হগোয়ার্টস্ প্রীতির ফলস্বরূপ সত্যি সত্যি সেখানে ঘোরা আমার হয়ে গেল। মাগল্ জীবনেও যে জাদুকাঠির ছোঁয়া লাগতে পারে, এই ভ্রমণের আগে তা স্বপ্নেও ভাবি নি।