লেখাপড়া করে যে


#pathshala #vernaculareducation

গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে  ||

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি

                             লেখাপড়া করে যেই| গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই||

এখন কথা হল লেখাপড়া করে কে? আজকের Digital India যুগে লকডাউনের সময় লেখাপড়া করা কার পক্ষে সহজ, আর কার পক্ষে কঠিন, সে তো দেখাই যাচ্ছে| আজ থেকে তিনশ - সাড়ে তিনশ বছর পেছিয়ে গিয়ে যদি এই প্রশ্নের উত্তর চাই, তাহলে? তখন অবশ্য গাড়ি চড়ার সুযোগ খুব কম লোকেই পেত, তবে ঘোড়া বাংলার গ্রামেগঞ্জে যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হত বই কি| যদিও লেখাপড়ার সঙ্গে গাড়ি ঘোড়া চড়ার কোনো সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না| আসলে এই ছড়াটা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক কালের, ইংরেজ আমলের, যেখানে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পেলে ভালো চাকরি পাওয়া যেত, অতএব গাড়ি ঘোড়া চড়ার সুযোগও মিলত|

          ১৮১৭ সালের ২১শে জানুয়ারী তৎকালীন কলকাতার সম্ভ্রান্ত হিন্দু ভদ্রলোকদের উৎসাহে এবং অর্থসাহায্যে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে ইংরেজি শিক্ষার দরজা খুলে গেল| কিন্তু সেই দরজা দিয়ে ঢোকার সুযোগ কি সবার জন্যেই সমান ছিল? আরো একটা প্রশ্ন মনে জাগে| কলেজ তো আসবে স্কুলের পরে| যেমন বেথুন স্কুল আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরে বেথুন কলেজের ক্লাস শুরু হয়| কেমন করে একটা কলেজের ক্লাস হবে, যদি তার আগে স্কুলের পড়া শেষ না হয়ে থাকে! এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আগে বুঝতে হবে সেই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল, কারা পড়াশোনা করত আর কি পড়ত|

          ১১ ডিসেম্বর ১৮২৩ সালে রাজা রামমোহন রায় একটা চিঠি লেখেন তখনকার বড়লাট লর্ড আমহার্স্টকে| বিষয়, সংস্কৃত স্কুল, বর্তমানের সংস্কৃত কলেজ, প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা| হিন্দু কলেজ তৈরী হয়েছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কিন্তু সংস্কৃত স্কুল স্থাপিত হয় সরকারী আর্থিক সহায়তায়, ১লা জানুয়ারী ১৮২৪ সালে|

 

To

His Excellency the Right Hon’ble William Pitt, Lord Amherst

My Lord

Humbly reluctant as the natives of India are to obtrude upon the notice of Government the sentiments they entertain on any public measure, there are circumstances when silence would be carrying this respectful feeling to culpable excess.

…  …  …

The establishment of a new Sanscrit School in Calcutta evinces the laudable desire of Government to improve the Natives of India by Education. … When this Seminary of learning was proposed, we understood that the Government in England had ordered a considerable sum of money to be annually devoted to the instruction of its Indian subjects. We were filled with sanguine hopes that this sum would be laid out in employing European Gentlemen of talents and education to instruct the natives of India in Mathematics, Natural Philosophy, Chemistry, Anatomy and other useful Sciences, ….

We now find that the Government are establishing a Sanscrit school under Hindoo Pundits to impart such knowledge as is already current in India. The seminary … can only be expected to load the minds of youth with grammatical niceties and metaphysical distinctions of little or no practicable use to the possessors or to society.

            রামমোহনের সময়ে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার দুটি সমান্তরাল ধারা ছিল বলা যেতে পারে, যেটা আবার আংশিক ধর্ম-নির্ভর| একদিকে টোল আর মাদ্রাসা – অন্যদিকে পাঠশালা আর মক্তব| এগুলি সবই ছিল অবৈতনিক, শিক্ষকদের মাইনে শুধু নয়, দূর থেকে আসা ছাত্রদের খাওয়া-থাকারও ব্যবস্থা করা হত| স্থানীয় রাজা, জমিদার, ধনী পরিবার ইত্যাদিরা এই স্কুলগুলির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন – যেমন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রানী ভবানী বা বীরভূমের আসাদুল্লা| টোল আর মাদ্রাসাকে বলা যেতে পারে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান| এখানে যা যা পড়ানো হত, যথা হিন্দু আইন, ন্যায়, স্মৃতি, কাব্য, অলঙ্কার বা ইসলামীয় ধর্মতত্ব, কোরান, হাদিস প্রভৃতি, তার সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের সত্যিই কোনো সম্পর্ক ছিল না| টোলে তো ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারোর প্রবেশাধিকারই ছিল না|  কিন্তু পাশাপাশি আর একটা সমান্তরাল স্কুল চালু ছিল সাধারণ ঘরের ছেলেদের জন্য – পাঠশালা| টোল আর মাদ্রাসার একটা ধর্মীয় রং থাকলেও, পাঠশালা ছিল প্রায় পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ| সেখানে হিন্দু মাস্টার আর হিন্দু ছাত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল মুসলমান ছাত্র আর মুসলমান মাস্টার| পাঠশালাকে বলা যেতে পারে এখনকার প্রাইমারি স্কুল| সেখানে বানান, কড়াকিয়া-গন্ডাকিয়া অঙ্ক আর হাতের লেখা শেখানো হত| চাষী, জেলে, কুমোর, কামার, ব্যবসায়ী এইসব অতি সাধারণ নিম্নবর্ণ নিম্নবিত্ত বাড়ির ছোট ছেলেরা পাঠশালায় পড়তে আসত, তারা টোলে পড়তে যেত না| টোলে যাবার কোনো সুযোগই তাদের ছিল না, কারণ ব্রাহ্মণরা নীচু জাতকে সংস্কৃত পড়াতে রাজিই ছিল না| তবে পাঠশালাতেও উঁচুজাতেরই সংখ্যা ছিল অনেক বেশি| ছোটজাতের আবার লেখাপড়ার দরকার কি, এই জাতীয় একটা মনোভাব যে শুধু ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের মধ্যেই ছিল তা নয়, নিম্নবর্ণের মধ্যেও যথেষ্ট সংস্কার ছিল লেখাপড়ার বিপক্ষে|

          দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়, প্রায় তা ভেঙে পড়ার মুখে ─ ১৮১৮ সালের William Ward আর ১৮৩৫ সালের William Adam-এর রিপোর্ট থেকে| বোঝাই যাচ্ছে যে তখনও টোলে পড়তে ইচ্ছুক হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যা আরবি-ফারসি পড়তে ইচ্ছুক হিন্দু ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি|

জেলা

আরবি-ফারসি স্কুলের শিক্ষক

আরবি-ফারসি স্কুলের ছাত্র

সংস্কৃত স্কুলের শিক্ষক

সংস্কৃত স্কুলের ছাত্র

 

হিন্দু

মুসলমান

হিন্দু

মুসলমান

                       হিন্দু

মুর্শিদাবাদ

 

১৯

৬২

৪৭

২৪

১৫৩

বীরভূম

৬৮

২৪৫

২৫৪

৫৯

৩৯৩

বর্ধমান

১০১

৪৫২

৫১৯

১৯০

১৩৫৮

দক্ষিণ বিহার

২৯০

৮৬৭

৬১৯

২৭

৪৩৭

ত্রিহুত

২৩৭

৪৭০

১২৮

৫৬

২১৪

সর্বমোট

১৪

৭১৫

২০৯৬

১৫৬৭

৩৫৬

২৫৫৫

 

মুঘল আমলে হিন্দু-মুসলমান দুজনেই আরবি ও ফারসি ভাষা শিখতে আগ্রহী হত সরকারি চাকরি পাবার জন্য| যারা প্রধানত জমির উপসত্বভোগী, জমিদার এবং জমিদারির নানান পদে অধিষ্ঠিত কর্মচারীবৃন্দ, তাদের পুত্রসন্তানদের কোনো অর্থকরীবিদ্যার প্রয়োজন ছিল না| ধর্মব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ আর অবকাশভোগী সচ্ছল পরিবারগুলি টোলের শিক্ষাব্যবস্থা বাঁচিয়ে রেখেছিল| মুসলমান আমলে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র জমিদারদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল হিন্দু কিন্তু কৃষকরা মুসলমান| অতএব ধর্ম আর অর্থিক স্তরের বিভাজন প্রায় একই রেখা বরাবর চলত|

          ১৭৫৭ সালের পর থেকে ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে সরকারি ভাষার রূপান্তর ঘটছিল, কিন্তু খুব ধীর গতিতে| ইংরেজরা প্রথমদিকে খুব সাবধানে পা ফেলেছে খ্রীস্টান ধর্ম আর ইংরেজি ভাষা নেটিভদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে| ১৭৮০ সালে Warren Hastings কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন মুসলমান আইনে বিশেষজ্ঞ অথচ কিছু ইংরেজি জানা কর্মচারী তৈরী করতে, যারা সরকারি অফিস আর আদালতে কাজ করতে পারবে, ইসলামি আইনের ব্যাখ্যা করতে পারবে| দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল মুসলমানদের হাত থেকে রাজত্ব নিয়ে নেবার পর, তাদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখা| সরকারি উদ্যোগে এটিই প্রথম ইংরেজি শেখানোর প্রতিষ্ঠান| এসবই যা ঘটছে তা কলকাতায়| বাংলাদেশের বাকি সব জায়গায় সেই পাঠশালা-টোল-মক্তব-মাদ্রাসা ব্যবস্থাই বহাল রয়েছে|

          ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সনদ পুনর্নবীকরণ করা হল| ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক একাধিপত্য কিছুটা হলেও সীমায়িত হল; ব্রিটিশ সম্রাটের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হল| মিশনারিদের কর্মকান্ডেও আর বিশেষ কোনো আপত্তি রইল না| সবচেয়ে বড় কথা হল, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মনে করল ভারতীয় নেটিভদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব| বছরে এক লক্ষ টাকা এর জন্য বরাদ্দ করা হল, লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠিতে রামমোহন যার উল্লেখ করেছেন| যে টাকা প্রাচ্যবিদ্যার চর্চায় খরচ করা হবে, না কি আধুনিক পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চায় খরচ করা হবে, তাই নিয়েই বিতর্ক|

          অথচ তৃতীয় একটা বিকল্প কি ছিল না? টোলে সংস্কৃত বা মাদ্রাসায় আরবি-ফারসি না শিখিয়ে পাঠশালায় বাংলা শেখানো? পাঠশালার সংখ্যা কিন্তু নিতান্ত কম ছিল না| শুধুমাত্র বর্ধমান জেলাতেই ৬২৯টা পাঠশালা, ৬৩৯ জন শিক্ষক আর ১৩১৯০ জন ছাত্রর হদিশ পাওয়া যায়| এদের অর্ধেক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ আর সদ্গোপ – বাদবাকিদের মধ্যে এমনকি বাগদি, ডোম, ময়রা, ধোবা, মুচি, হাঁড়ি ইত্যাদিও ছিল| মুসলমান ছিল ৭৬৯ জন আর খ্রিস্টান ১৩ জন| টোলের শিক্ষাব্যবস্থা ব্রাহ্মণদের হাতে থাকলেও, পাঠশালার শিক্ষকরা ছিল প্রধানত কায়স্থ| আর যেহেতু এদের জীবিকা নির্ভর করত পড়ুয়াদের দেয় সামান্য দক্ষিণার ওপর, ছোটজাতকে হেলাফেলা না করে পাঠশালায় নিয়ে আসলে নিজেদেরই লাভ হত!

তবে এটাও সত্যি যে উচ্চবর্ণ কখনোই চাইত না যে নিচু জাতের মধ্যে লেখাপড়ার কোনোরকম চর্চা হোক| জমিদার আর তাদের বেতনভোগী কর্মচারীরা স্বভাবতই চাইবে না যে রায়ত শ্রেণী শিক্ষিত হয়ে ওঠে| হয়ত তাদের জন্যই বলা হত

লিখিবে পড়িবে মরিবে দুখে| মৎস্য মারিবে খাইবে সুখে|

এই জমিদারশ্রেণীর সঙ্গেই ইংরেজের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠল| তারা যেমন দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত, তেমনই তাদের হাতে সুযোগ এল ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার| ডেভিড হেয়ার সাহেব, রামমোহন এবং আরো অন্যান্য সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে লক্ষাধিক টাকা তুলে প্রেসিডেন্সি কলেজ তৈরী করা ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ|

 

 

তথ্যসূত্র: প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিবৃত্ত, বিশ্বনাথ দাস| থীমা ২০১১

Indigenous vernacular education in pre-British Era: Transitions and Problems. Poromesh Acharya. Economic and Political Weekly. 1978