ছোটবেলায় আমি বেড়াতে যাবার ডায়েরি লিখতাম| সেখানে সব রকম খুঁটিনাটি, এমনকি কি খেলাম না খেলাম, সব কিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে রাখার চেষ্টা করতাম| মনে আছে একবার লিখেছিলাম, “এক পিস হোঁৎকা পাঁউরুটি খেয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম”| সেটা পড়ে সবাই খুব হেসেছিল| তখন আমার বয়স বোধহয় আট| যদিও এত হাসাহাসি করার মত বিশেষ কোনো কারণ আমি বাপু খুঁজে পাইনি| খাওয়া-দাওয়া তো বেড়ানোর অংশ বটেই| এখন সব বেড়ানোর ম্যাগাজিনে বিদেশের ভীষণ দামী হোটেলের ভালো ভালো মেনু দেওয়া থাকে এমন ভাবে যে সেখানে না খেলে জীবনই বৃথা! আবার এর উল্টোটাও দেখেছি, বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে| রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে পোস্তর বড়া আর ইতালির ট্রেন্টোতে ভাপা ইলিশ পাওয়া যায় না বলে তাদের রাগ হয়! আমি ফিনল্যান্ডে গেছিলাম প্রায় দশবারো দিনের জন্য| সে অনেক দিন আগে, গুগল-জমানা তখনও শুরু হয়নি| আমাকে এক সহকর্মী উপদেশ দিয়েছিল, “ওখানে তো দেশী খাবার পাবে না, ভালো চাল আর মুসুর ডাল সঙ্গে নিয়ে যেও; আর ডিম আর আলু কিনে নিও|”
তবে সব কিছুরই দুই দিক রয়েছে| আমেরিকাতে থাকার সময়ে একবার একমাসের জন্য আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম| তখন একটা স্টেশন ওয়াগন চালাতাম আমরা, পেছনের সীটটা নামানো যেত| টেক্সাস থেকে রওনা হয়ে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সব কটা National Park ঘুরে, এমনকি আলাস্কা হয়ে আবার টেক্সাসে ফিরে আসা| ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সেই অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল| তখন আমাদের এক শুভানুধ্যায়ী জোর করেই তাঁর ইলেক্ট্রিক হীটারটা আমাদের গছিয়ে দিয়েছিলেন| বলেছিলেন, “এটা নাও, আর কয়েকটা প্লেট, চামচ, একটা সসপ্যান নিয়ে যেও| এক মাস ধরে রোজ কয়েক শ’ মাইল গাড়ি চালিয়ে দুবেলা Big Mac আর Whopper খেতে ইচ্ছে করবে না| সন্ধেবেলা হোটেলে ঢুকে গরম ভাতে-ভাত, মাখন আর আলু-ডিম সেদ্ধ খেও, মনে হবে অমৃত|”
যাই হোক, কথাটা শুরু হয়েছিল ডায়েরি লেখা নিয়ে| ছোটবেলায় লিখতাম, এখন আর লিখি না| বেড়ানর ছবি তোলা হয়, ডিজিটাল ক্যামেরা, ফোন ক্যামেরায় হাজার হাজার ছবি| সেইজন্য দেখাও হয় না বড় একটা| কয়েক বছর পর ভুলেও যাই কোথায় কি দেখেছি| এখন এত তথ্য এত ছবি এত বেশি হাতের নাগালের মধ্যে, ঘরের কোনে বসে বসেই দিব্যি সারা পৃথিবী চষে ফেলা যায়| এমনকি যদি Internet থেকে ছবি নামিয়ে Photoshop করে, তার মধ্যে নিজের ছবি বসিয়ে সবাইকে দেখাই, কেউ কি বুঝতে পারবে? কথাতেই আছে ...... মহাবিদ্যা!
কোথাও বেড়াতে যাওযার অর্থ এক এক ভ্রমণপিপাসুর কাছে এক এক রকম| দার্জিলিং আমি যতবারই যাই না কেন, চিড়িয়াখানায় লাল পান্ডার সঙ্গে দেখা করে না এলে মনে হয় না বেড়ানোটা সম্পূর্ণ হল| তার সঙ্গে Glenary’s আর Keventers-এও যেতে হয় বৈ কি! Glenary’s এখন দার্জিলিং ভ্রমণকারীর অবশ্যকরণীয় ফর্দের অঙ্গ| মুশকিল হল ফর্দটি যদি যথেষ্ট রসিক ব্যক্তির করা না হয়, তা হলে চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস খেতে যে Glenary’s-এ যেতে নেই, তা বলা থাকে না|
সমমনস্ক সঙ্গী না হলে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ সবই মাটি| প্রথমবার Luray Caverns-এ গেছি| মুগ্ধ হয়ে stalactite আর stalagmite-এর রং আর নানান আকৃতি দেখছি| সঙ্গী একজন বলে উঠল, “আরে ঐ পাথরের ঝোলাঝুলি কী আর দেখব!” ঐ জন্যই তো Travel Agent-এর মারফৎ বেড়াতে যেতে ইচ্ছে হয় না, যদিও জানি সেটা সস্তা, ঝামেলাও কম|
আবার সেই ডায়েরির কথাতেই ফিরে আসি| ডায়েরি আর রাখি না, তার একটা কারণ অবশ্যই – আলস্য| কিন্তু আর একটা কারণ, প্রধান কারণ, যে ছবিগুলো মনে ধরে রাখে, তার জন্য ডায়েরি লেখার দরকার হয় না| সেগুলো একদমই আমার নিজস্ব| ছাত্রাবস্থায় আমরা একবার গ্রেহাউন্ড বাসে চেপে পেনসিলভেনিয়ার স্টেট কলেজ থেকে টেক্সাসের হিউস্টন গেছিলাম| সে প্রায় দেড় হাজার মাইলের পথ, তায় গ্রেহাউন্ড বাস সোজা পথে যায় না, বিভিন্ন ছোট-বড় শহর ঘুরতে ঘুরতে যায়| বেশ অনেকবার বাস বদলাতে হয়| ছাত্র থাকাকালে তো সময়ের অভাব ছিল না, পয়সার অভাব ছিল| তখন ক্রিসমাসের ছুটি| বাসে বা ট্রেনে আমি বেশ অনায়াসেই ঘুমিয়ে পড়তে পারি| মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে চোখ মেলে দেখি গভীর রাতের বাস ছোট ছোট শহরের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে, জানলায় ক্রিসমাস ডেকোরেশন, একটা-দুটো ইলেক্ট্রিক মোমবাতি জ্বালানো, দরজায় ক্রিসমাস wreath – সে যে কি সুন্দর লাগছিল, যেন রূপকথার দেশ! বাইরে বরফ পড়ছে| তাতে রূপকথার effect-টা আরোই ভালো হয়েছিল| তবে রূপকথার দেশেও তো দুষ্টু জাদুকর থাকে| বাইরের বরফটা ছিল ভালো রকমের blizzard – সমস্ত Mid-West জুড়ে| আমাদের বাসকে রাস্তা বদল করতে হল, দেরী হল, ২২ ঘন্টার বাস ভ্রমণ ২৮-২৯ ঘন্টায় পর্যবসিত হল| এই রকম বেডানোর অভিজ্ঞতা তো মনের মধ্যে থেকেই যায়, তাকে মনে করাতে ছবিও লাগে না, ডায়েরিও লাগে না| আর এ হল একেবারে আমার ব্যক্তিগত – ঠিক ভ্রমণসঙ্গীতে লেখার মত নয়|
বাসে বা ট্রেনে আমার ঘুমিয়ে পড়া নিয়ে অয়নের নানান বাহানা| আমি যা দেখি, তা নাকি ঘুমিয়েই দেখি, অর্থাৎ স্বপ্নে দেখি, চোখ খুলে দেখি না| কারণ অয়ন ঘুমোতে পারে না, জেগেই থাকে, অথচ সে কিছুই দেখতে পায় না| অস্ট্রেলিয়াতে ট্রেনে চেপে যাচ্ছি, বোধহয় সিডনি থেকে ক্যানবেরা| একসময়ে হঠাৎ দেখি বেশ এক বড় দঙ্গল ক্যাঙারু ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে| “ঐ দেখ, ঐ দেখ” বলতে বলতে তারা বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে চলে গেল| অয়ন যদি ঠিক সেই সময়েই ঘুমোয়, সেটা কি আমার দোষ? এই সদ্য টাকি গেলাম গাড়ি চালিয়ে| রাস্তায় হাজারে হাজারে কুমড়ো, ওলকচু, কাঠাঁল আর আনারস – কলকাতায় আসবে বলে অপেক্ষা করছে| তাই নিয়ে মন্তব্য করলেই অয়নের ধমক, “আঃ রাস্তা দেখ না!” আরে রাস্তা দেখছি বলেই তো এসব চোখে পড়ছে, গুগল ম্যাপে নাক ডুবিয়ে বসে থাকলে কি এসব দেখা যায়?
বারো ক্লাস পাশ করার পর কি পড়ব ঠিক করার সময়, আমার জিওলজি পড়ার খুব ইচ্ছে হয়েছিল| তাহলে অনেক দুর্গম জায়গায় বেড়ানো যাবে| কিন্তু সমস্যা, আমি কেমিস্ট্রিতে কাঁচা, মুখস্ত করতে পারি না| তখন ঠিক করলাম স্ট্যাটিস্টিক্স পড়া যেতে পারে| ঐ একটা বিষয়ে ভারতীয়রা পৃথিবীর অন্যান্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিতে পারে, তার মানেই বিদেশে বেড়ানোর অফুরন্ত সুযোগ| যাদৃশী ভাবনা যস্য ... সিদ্ধি তো তাতেই আসে| তা বেড়ানোর শখ, এই বন্দীজীবনের আগে পর্যন্ত, ভালই মিটিয়ে এসেছি| ভবিষ্যতে কি হবে জানিনা, কোভ্যাক্সিন নিয়েছি তো! বাংলাদেশেও হয়তো ঢুকতে দেবে না, আমেরিকা, ইউরোপ তো কোন ছার| তা রবীন্দ্রনাথ তো বলেই গেছেন ধানের শীষে শিশিরবিন্দু দেখে নিতে| নিজে অবশ্য তা বলে জাভা থেকে চীন, জাপান হয়ে প্যারিস, জার্মানী, লন্ডন, রাশিয়া, ইরান, আমেরিকা – কিছুই ঘুরতে বাদ রাখেননি|
বেড়ানোর আনন্দ এক এক জনের কাছে এক এক রকম| বিদেশী ট্যুরিস্টরা এদেশে আসে পিঠে একটা প্রকান্ড ব্যাকপ্যাক চাপিয়ে| ওর মধ্যেই ছমাসের যত প্রয়োজনীয় জিনিস| মাথার ওপর ছাদ পেল তো ভাল, না হলে ট্রেন স্টেশনে বসে বা শুয়ে কাটিয়ে দিল| এরা সবাই যে একেবারে ড্রাগখোর, তা মোটেই নয়| আমার এক খুব ঘনিষ্ঠ আমেরিকান বন্ধু দু বছর নেপালে ছিল, Peace Corp-এর হয়ে পাহাড়ী বাচ্চাদের পড়াত| Ohio State University থেকে সদ্য BS শেষ করে, কি ভেবে চলে এসেছিল এই তল্লাটে| যখনই ছুটি পেত, ভারতে চলে আসত – দিল্লি, আগ্রা, রাজস্থান, বেনারস চষে ফেলেছিল ট্রেনে, বাসে আর পায়ে হেঁটে| দু বছর পরে দেশে ফিরে Penn State University-তে PhD করতে এল| আমার সঙ্গে সেখানেই বন্ধুত্ব| একবার আমাকে বলেছিল, ভারতবর্ষে এভাবে না বেড়ালে Somerset Maugham-এর The Razor’s Edge বইটার মর্ম না কি সে কোনোদিনও বুঝত না|
তা মাইক আমার যতই বন্ধু হোক, কঠিন কঠিন বইয়ের মর্ম অনুধাবন করার জন্য বেড়ানো আমার পোষায় না| আমি বুদ্ধদেবের মত মধ্যপন্থাবিলাসিনী| একেবারে 5-star হোটেলে না থাকলেও, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় থাকতে হবে| ইউরোপে অনেক হোটেলেই আবার বাথরুমটা ঘরের মধ্যে থাকে না| সে এক ফ্যাকড়া| সকাল বেলা ঘুম চোখে আমি প্রাতঃকৃত্য সারতে সেখানে ঢুকছি, আর এক সাহেব জন্মদিনের পোষাকে ধারাস্নান সারছে, এ হেন দৃশ্য আমার সহ্য হবে না| অতএব মাথা গোঁজার ঠাঁইটা, দুদিনের জন্যে হলেও, সুবিধেজনক হতে হবে| গাড়ি করে না বেড়ালেও চলবে, ট্রেন বা বাস যথেষ্ট ভালো, আর মেট্রো হলে তো কথাই নেই| তবে গণপরিবহন বেশ কয়েকবার আমাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছে| সে গপ্প আর একদিনের জন্যে রইল|
Travel Diary
কতো ঘুরেছিস তু্ই. খুব ভালো লাগলো. আরো লেখ
Soma
07-10-2021 20:52:59