ভোলা মন


#

রেডিওতে  গান বাজছে, " ও ভোলা মন /তুই চিনলি নারে  কে তোর আপন জন।" কবিরা বেশ  গোলমেলে লোক কিন্তু।  ছোটবেলা থেকে ছলচাতুরি করে  ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছি,  ঠিক বুঝতে পেরে গেছে।  তাতেও রক্ষে নেই,  লিখে,  সুর দিয়ে আবার  গান ও গেয়ে ফেলা হয়েছে।  তাহলে খুলেই বলি।

 কাগজে লেখা অথবা ছাপা শব্দ মাথার ভেতর যেভাবে সজোরে গেঁথে যায়, কানে শুনে তার অর্ধেকও মনে রাখতে পারিনা। আর মানুষের মুখ এবং সঠিক নাম পরিচয়, এটা মনে রাখা আমার কাছে দুঃসাধ্য ঘটনা। ছোটবেলায় এই সমস্যা খুব সামান্য আকারে বর্তমান ছিল কারণ চেনাজানার পরিধি ছিল ছোট। স্কুল আর বাড়ির বাইরে বিশেষ মেলামেশা করার অবকাশ ছিল না। একই স্কুলে পড়েছি ১০ বছরের ওপর। ফলে ক্লাসের সবাইকে মোটামুটি চিনতাম। মাঝে মাঝে সেকশন বদল হত, তখন একটু মুশকিলে পড়তাম। একবার যেমন, আমি ক্লাস মনিটর, সেদিন টিচার আসেননি, আমার উপর গুরুদায়িত্ব, যারা কথা বলবে তাদের নাম লিখে রাখতে হবে। আমি রমার বদলে ঝরনার নাম লিখে দিয়েছি অথচ ঝরনা সেদিন স্কুলেই আসেনি। ক্লাস টিচার সুষমাদি কড়া গলায় জানিয়েছিলেন, মনিটরের জন্য এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তারপর থেকে নিশ্চিতভাবে না জেনে কারো নাম লিখি নি, ফলে কোন সমস্যাও হয়নি।

 কলেজে তো জনসমুদ্র। যারা হোস্টেলে থাকতো তারা অনেক বেশি সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে চিনতো। শুধু নিজেদের ব্যাচ নয়, অন্য ব্যাচেরও। এদিকে আমি তো কাকে তুই /তুমি /আপনি বলবো সেটা নিয়েই সমস্যায় পড়তাম। একবার আদিত্যকে আপনি বলায় সে খুব অবাক। ক্লাসমেটকে খামোখা আপনি বলছিস কেন?আর মনিকাদিকে তুই বলে বকুনি খেয়ে ছিলাম। আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়, আমায় দিদি আর তুমি বলবে।

তাছাড়া বন্ধুমহলে পি.এন.পি.সি. চলাকালীন কার সম্বন্ধে কথা হচ্ছে আমি অনেক সময়ই বুঝতে পারতাম না ফলে তেমন উপভোগ করতাম না। এইজন্য ভালো মানুষেরা আমাকে উচ্চমার্গ বিচরণী এবং হিংসুটেরা আমাকে আঁতেল আখ্যা দিয়েছিল। তবে আসল কারণটা কেউ বুঝতে পারেনি।

 সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছিল বিয়ের পর। শ্বশুরবাড়ি এবং মামাশ্বশুর বাড়ির অগুনতি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বাসি বিয়ে এবং বৌভাতের দিন। ওই দুদিনে এতো মানুষকে মনে রাখা বোধহয় কারো পক্ষেই সম্ভব নয় আমার তো নয়ই। পরবর্তী সময় যখন কেউ বাড়িতে এসেছেন, শাশুড়ি মাকে খবর দিয়েছি, কে যেন এসেছে, তোমায় ডাকছে। শাশুড়ি মা যখন দেখলেন সেই 'কে যেন' হলেন তাঁর প্রিয় বোন, তখন যে বিশেষ প্রীত হলেন না, সে কথা বলাই বাহুল্য।

 সিদ্ধার্থকে একবার বলেছিলাম, 'তোমার সেই মামাতো বোনের নামটা বলোনা, ভুলে গেছি, সেই যে গো, যে এয়ারহোস্টেস-এর চাকরি ছেড়ে বিয়ে করল' (এই ব্যাপারটা আমার কাছে পৃথিবীর প্রথম আশ্চর্য), সিদ্ধার্থ অবলীলাক্রমে, 'আমার অমন কোন মামাতো বোন নেই' বলে চুপ করে গেল। বেশ বুঝেছে আমি ভুল করে মাসতুতো বোনকে মামাতো বোন বলেছি। যাকগে, কবেই বা আর স্বামীরা স্ত্রীদের সর্বাঙ্গীন সহায়তা করে! এই জন্য সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা সর্বদা ঝংকৃত হয়ে থাকেন মানে ঝংকার দিয়ে কথা বলেন।

 একবার ননদ কে বলেছিলাম ঝুমুমাসির শাড়িটা কি সুন্দর, না? ননদ হেসেই খুন, 'উনি মোটেও ঝুমু মাসি না, ওনার বেয়ান। বোঝো কান্ড।

আরেক বড় সমস্যা হলো, ছেলের স্কুলে কোন বাচ্চার মা কোন জন। 'আচ্ছা, হর্ষদ কেমন আছে? ওর জ্বর হয়েছিল না?' এই প্রশ্নে বিরক্ত মায়ের উত্তর, আমার ছেলের নাম ঋজু, ওর কোন জ্বর হয় নি।' অথবা, 'শুনলাম, দিব্যানের প্রজেক্ট দারুণ হয়েছে, সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে। ওকে কংগ্রাচুলেশন জানাবেন।' 'আমার ছেলে, অনমিত্র। ওর প্রজেক্ট ও সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে, থ্যাংকস।' প্লাস্টিকের মত মুখ করে ভদ্রমহিলার উত্ত।র এত বিরক্তি কিসের, কে জানে! নিজেদের যেন ভুল হয় না!

 আবার কে কোন সাবজেক্টের টিচার, এটাও ঠিক ঠাক মনে রাখতে পারি না। 'স‍্যর, সায়কের অংকের নম্বর কনস্ট‍্যান্টলি কম আসছে, কিছু বলবেন ওর ব্যাপারে?' 'আমি তো কম্পিউটার টিচার, বাচ্চা টীচারটি আমতা আমতা করেন, 'ওইদিকে যান, সুমিত স্যারের কাছে। আবার উল্টো বিপদ ও আছে। 'আপনিতো শায়কের মা, ডাক্তার, আমাকে একটা প্রেসক্রিপশন করে দেবেন? রাইট নী জয়েন্টের একটা এক্স-রে করাতে হবে।' এটা তো আমার কাছে কোন সমস্যাই নয়, কিন্তু নাম ছাড়া প্রেসক্রিপশন লিখব কিভাবে? অগত্যা বলতে হয়, আপনার নাম আর বয়সটা একটা কাগজে লিখে দিন, আমি প্রেসক্রিপশন প‍্যাড ক্যারি করছি না। পরে পাঠিয়ে দেবো।

 চাকরি জীবনেও নাম মনে রাখাটা বেশ চাপের ব্যাপার। ছাত্র-ছাত্রীদের নাম মনে রাখার ব্যাপারে আমাদের মাস্টারমশাইদের মধ্যে প্রবাদ পুরুষ ছিলেন অধ্যাপক কালী কৃষ্ণ ভট্টাচার্য। আমার সমসাময়িক বেশকিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার ও এই গুণ আছে। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের নাম মনে না রাখাটা বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করে না। আমার মনে হয় ছাত্র-ছাত্রীরাও সব শিক্ষক শিক্ষিকার নাম মনে রাখে না। অবশ্য ওদের স্যার, ম্যাম এইসব বলে চলে যায়, কিন্তু আমার তো 'হাই স্টু' বলে কাজ চালানোর উপায় নেই! তাই কিছু নাম মনে রাখতেই হয়। কিন্তু কলীগদের নাম ভুলে গেলে চলে না, অন্তত পেশেন্ট রেফার করার জন্য বা তাদের ফোন নাম্বার খুঁজে বার করার জন্য নাম মনে রাখা বিশেষ জরুরী।

 একবার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে পোস্টেড। কৌস্তুভদা একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো। বলল, নতুন জয়েন করেছে আমাদের ডিপার্টমেন্টে, একটা ব্লাড টেস্ট করাতে হবে । জানতে চাই, কি টেস্ট। যখন শুনলাম থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট, তখন বললাম, চলো, ফর্মটা ফিল আপ করে নি। তারপর গম্ভীর মুখে নাম, ধাম, কতদিনের অসুখ, আগে কোনো অসুখ ছিল কিনা ইত্যাদি বিস্তার প্রশ্ন করে ফরম ফিল আপ করা হলো। তারপর বললাম, বেশ, তাহলে আগামীকাল খালি পেটে চলে এসো সকাল সাড়ে নটার মধ্যে।

 শিক্ষিকাটি বলল, 'বাই এনি চান্স, তুমি কি বেথুন থেকে 12 পাশ করেছ? হ্যাঁ। ১৯৮১ ব‍্যাচে? আমায় চিনতে পারলে না? আমি ক্রাইস্টচার্চ থেকে বেথুনে গিয়েছিলাম, ক্লাস 11এ, রোল নাম্বার 21।

ওহো তাইতো, শ্রাবণী, চিনতেই পারিনি 

আমিও প্রথমে চিনতে পারিনি তারপর তোর কথা বলার ধরণ দেখে…. আর নামটা তো জানতাম…. দুটো মিলিয়ে মনে পড়ে গেল।

 আসলে মোটা হয়ে গেছি তো।

 তাহলেও...দেখ দুজনের কেউ কাউকে চিনতেই পারিনি।

 হতবাক কৌস্তুভদার সামনে অনাবিল হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠি কিশোরী বেলার দুই বন্ধু।

 ও ভোলা মন গানটির সম্প্রসারণ শেষ হলো। সে কবি যাই বলুক, সব আপনজন কি সত্যি আপন! মিথ্যে আপনজনদের না চিনলে ক্ষতি কি? আর সত্যি আপনজনদের ঠিকই চেনা যায়, কোন ভাবে না কোনো ভাবে। ফাঁকি দেবার সাধ্যই নেই ।