মানুষের স্মৃতি খুব অদ্ভুত বস্তু। কোন জিনিস যে মনের গভীরে কিভাবে জায়গা করে নেয়, তার কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক প্রায় ই খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ মনে পড়লো ছোটবেলায় পড়া একটা গল্প। সত্যি বলতে কি গল্পটা বিশেষ মনে নেই, কিন্তু সঙ্গের ছবিটা খুব মনে আছে।একটা উঁচু বাড়িতে এক রাজকন্যা বসে আছে, মুখে একরাশ বিষন্নতা । জানলা দিয়ে ছড়িয়ে আছে তার একঢাল কালো চুল, যা সেই বাড়িকে ছাড়িয়ে ছুঁয়ে গেছে মাটিকে। অনেক পরে গ্রীম ভাইদের রাপুঞ্জেল পরে বুঝেছি সেই বিখ্যাত গল্পের ছায়া অবলম্বনে এই গল্পটা লেখা। যদিও এই সব বন্দিনী দুঃখী রাজকন্যা কোনোদিন আমায় আকর্ষণ করে নি। বরং টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়া রাজপুত্র দের কার্যকলাপ অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। যাক সে কথা, তথাকথিত মেয়েলি ব্যাপারে উৎসাহ না থাকলেও মাতৃদেবীর কল্যাণে খুব ছোট থেকেই জেনেছি মেয়েদের সৌন্দর্যে চুলের বিশেষ ভূমিকা। সংসারের ঊনকোটি কাজ সামলে মাঝে মাঝে মা আমার চুলের পিছনে পড়তেন। সে রীতিমতো অত্যাচার।চুপচুপে করে নারকেল তেল দিয়ে কালো দড়ি দিয়ে টেনে টেনে চুল বেঁধে দিতেন।এতে নাকি চুল বড়ো হবে। মাঝে মাঝে শ্যাম্পু করে দিতেন।সে ভারী খুশির দিন।শ্যাম্পু পরবর্তী ঝাঁকড়া চুলগুলো নিজেরই ভারী ভালো লাগতো।
হঠাৎ একদিন বাড়িতে ফিসফিস, গুজগুজ। এক বাঙালি না কি তেলের ব্যবসা শুরু করেছে। বিজ্ঞাপন দিয়েছে কাগজে। সেন বাড়ির ছেলের এ কি দুর্মতি! বলে রাখি, বিয়ের আগে মায়ের পদবি ছিল সেন। সেই সূত্রে যাবতীয় সেনদের সুকৃতি/দুষ্কৃতীর দায়ভার মাথায় নিতে তার কোনো আপত্তি ছিল না। তেলের নাম জবাকুসুম।কোনো এক পন্ডিত বাড়ির ছেলে সি কে সেন এর আবিষ্কার। নানা আলোচনা/সমালোচনা কে উপেক্ষা করে জবাকুসুম বাজার দখল করলো এবং একদিন আমাদের বাড়িতেও প্রবেশ করলো। এ প্রসঙ্গে মা কে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস বা ইচ্ছে কিছুই নেই, কিন্তু নতুন তেল মাখার কৌতূহল প্রবল। মায়ের ইচ্ছেতে একদিন সে তেল আমার চুলেও উঠলো কিন্তু মন ভরলো না। আসলে মন কি চাইছিলো নিজেই জানতো না। কিছুদিন বাদে জবাকুসুমের উন্মাদনা কমে এলো, আমরা আবার নারকেল তেলে ফিরে গেলাম। তবে একটা ব্যাপারে জবাকুসুম পথ দেখিয়েছিলো, তা হলো বিজ্ঞাপন পড়ার অভ্যাস আমার সেই থেকে শুরু।
ক্রমশ বুঝতে শুরু করলাম আমার চুল বড়ো হবার নয়। কোঁচকানো চুল বোধ হয় বাড়ে না। স্কুল কলেজে কত মেয়ের কত ঈর্ষণীয় লম্বা চুল, হাতিবাগানের কথা ছেড়েই দিলাম, মানিকতলায় পর্যন্ত তাদের চুলের জন্য কত রকমারি সাজ। আমার জন্য কালো ক্লিপ ছাড়া কিছুই নেই।
একদিন মা নিয়ে গেলো একটা দোকানে। সেখানে মেয়েদের চুল কাটা হয়।ভারী সুন্দরী ছোটোখাটো চেহারার এক বিদেশিনী, স্কার্ট পরে নানা বয়সী মেয়েদের চুল কাটছেন, আমাদের দু বোনের চুল ও কেটে দিলেন, আয়নায় নিজেদের দেখে আর আশ মেটে না। কেবল চুল কেটেই চেহারায় কেমন আমূল পরিবর্তন আনা যায়, সেদিন তার প্রথম পাঠ পেলাম।তার পর যত বড়ো হয়েছি, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, সব কিছু থেকে চুলের স্টাইল নিয়ে অজস্র জ্ঞান লাভ করেছি। বয়েজ কাট, স্টেপ কাট, রাউন্ড কাট কত রকমারি ভাবে যে চুল কাটিয়েছি।
এত কিছুর মাঝে মাসতুতো দিদি, বুবুদির বিয়ে হলো। ওরা দুই বোন আর ওদের মা মানে আমার কুট্টিমাসী আমাদের স্টাইল আইকন। সেই প্রথম মা কে দেখলাম পার্লার থেকে খোঁপা বেঁধে আসতে।খুব সাধারণ ভাবে থাকা আর নামমাত্র সাজগোজ করা মা কে যেন চেনাই যায় না। রাতে অবশ্য মায়ের কি আক্ষেপ। ল্যাকার দিয়ে চুলের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, আর কক্ষনো যাবো না ইত্যাদি। আমাদের বারবার বলতেন, চুলে কেমিকাল ব্যবহার কত খারাপ।কিন্তু ততদিনে আমার নিজস্ব চিন্তা, মতামত তৈরী হয়েছে, স্বাধীনতার মজা পেয়েছি, কলকাতার অলি গলি চিনেছি, একা বেরোতে ভয় পাই না। অতএব মায়ের সব কথা মেনে চলার আর প্রশ্ন ই নেই।
বিয়ের পর তো আরো মজা, পড়তে গেলাম ওয়ারধা। তখন হেয়ার লক কাটছে সবাই, আমিও কাটলাম। আমার সহকর্মীদের মুখের ভাব দেখে বুঝলাম অত্যন্ত খারাপ দেখাচ্ছে। তাও সিওর হবার জন্য জিজ্ঞেস করলাম খুব খারাপ হয়েছে? রাজি বলে এক বন্ধু ছিল, বললো, আমরা হরিনাথ স্যার এর গালাগালি সহ্য করে বড়ো হয়েছি, এটা ও সহ্য করে নেবো।এই ঘটনার পর আর কোনোদিন নিজের চুল নিয়ে কোনো পরীক্ষা করি নি। তারপর বয়স বাড়লো, ছেলে আমেরিকা গিয়ে চুল সোনালী করলো, আমার চুল স্বাভাবিক ভাবে রুপোলি হতে লাগলো। এই নিয়ে দুজনে মজাও করলাম।
তারপর হঠাৎ এলো সেই দিন। মেদিনীপুর থেকে ফেরার পথে নিজের গাড়িতে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘুম ভেঙে দেখি অন্য গাড়ি চড়ে যাচ্ছি, অচেনা একটা ছেলের কোলে মাথা, সে চেপে ধরে আছে মাথার একটা অংশ। এবার আমার আর্তনাদ। কে আপনি? তখন শুনি আমার গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে, পুলিশের গাড়ি চড়ে যাচ্ছি উলুবেড়িয়া হাসপাতাল। একটু আশ্বস্ত হলাম । সেখানে সনৎ আছে, আমার বন্ধু। পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে বেশ খাতির করে ও.টি. নিয়ে গেলো।বললো, মাথা ফেটে গেছে, সেলাই করতে হবে, পা ও ভেঙেছে, আপাতত প্লাস্টার করে দিচ্ছি।তারপর সনৎ এর তত্বাবধানে মাথার চুল কেটে ফাটা জায়গা সেলাই করে দিলো। তখন আমার কথা বলার ক্ষমতা নেই। এরপর নিয়ে আসা হলো কলকাতা। আবার মাথার সেলাই কেটে সেলাই হলো, এবার একটা ড্রেন বসানো হলো, যাতে রক্ত ভেতরে জমা না হয়ে ওই ড্রেন এ জমা হয়। সে এক অদ্ভুত চেহারা।ন্যাড়া মাথা সঙ্গে এক পাশে ঝোলা টিকি, মাথা নাড়লে টুকটুক টিকি দোলে।মনে পড়লো হটু বিদ্যালংকারের কথা। যখন মেয়েদের পড়াশুনা র চল ছিল না, সেই যুগে এই ভদ্রমহিলা পড়াশুনা করে, মাথা ন্যাড়া করে, টিকি ঝুলিয়ে, নিজের টোল খুলে ছাত্র পড়াতেন। নিজের টোল না থাকলেও ছাত্র পড়ান চলছে সেই কোন কাল থেকে। নিজেই নিজের নাম দিলাম সোমা বিদ্যালংকার। জন্মের সময় তো ন্যাড়া মাথাই ছিল, পৈতের সময় যে দ্বিতীয় জন্ম হয়, তখন ও তো মাথা ন্যাড়া করতে হয়। নবজন্ম লাভের সময় আমার বেলায় ও নয় সেই নিয়মের ব্যতিক্রম না ই বা হলো।
মেঘবরণ কেশ
হটু বিদ্যালংকার - দারুণ। আপনার জীবনী শক্তিকে কুর্ণিশ Ma'am
Sanghamitra
15-05-2025 10:46:40