পেঙ্গুইন এবং ঘরে ফেরার গান


#

 মেলবোর্ন,অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। তুলামারিন এয়ারপোর্টে সিদ্ধার্থ একটা ক্যাঙ্গারু সফট টয় দিয়ে আমাকে আর বুবকাকে অভ্যর্থনা জানাল। সিদ্ধার্থ একটা কাজে এসে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউসে আছে প্রায় এক মাস।  এখন বাড়ি ফেরার সময় আমরা এসে হাজির। একসাথে ঘুরব তারপর একসাথে বাড়ি ফিরব।

 শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে ইয়ারা নদী। "শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি," সেটি গিয়ে মিশেছে পোর্ট ফিলিপ বে। তারই কাছে ফিলিপ আইল্যান্ডে পেঙ্গুইন দেখতে যাওয়ার কথা। নির্দিষ্ট সময়ে বাস ছুটল ইয়ারা নদীর পাশ দিয়ে। প্রথম গন্তব্য ওয়ারুক ক‍্যাটল ফার্ম। নামে ফার্ম হলেও সেখানে গরু-মোষ দেখা যায় নি, যদিও পথে চোখে পড়েছে বিশালাকৃতি গরু। তাদের জন্য নাকি বিপুল বন্দোবস্ত, আর ওইসব গরুর দুধ থেকে যে চীজ্ প্রস্তুত হয় তার নাকি বিশ্বজোড়া খ্যাতি।

প্রথম চোখে পড়ল একটা ক্যাঙ্গারু, দর্শনার্থীদের আদরের আতিশয্যে তাকে বেজায় ক্লান্ত মনে হলো। একই খাবার নিয়ে অগণিত দর্শক তার পেছনে ধাওয়া করেছে, সেও দৌড়ে পালাচ্ছে, হয় খাবারের অনিচ্ছায়, নয়তো মজা করে। আর তাদের সবার পিছনে উৎসাহী ফটোগ্রাফাররা ক্যামেরা বাগিয়ে দৌড় লাগিয়েছে, সম্পূর্ণ দৃশ্যটি একই সাথে মনোহর এবং হৃদয়বিদারক।

 দেখলাম এমু পাখি। বেশ কয়েকটা ফটোসেশনের জন্য পোজ দিয়ে দাঁড়াল। তাই দেখে একটা অপরূপ রূপসী সাদা ময়ূর হেলেদুলে এগিয়ে এসে হঠাৎ পেখম মেলে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। আমি বললাম, নিশ্চয়ই বৃষ্টি হবে। ওরা বৃষ্টির খবর পায়। তখন খটখটে রোদ্দুর। বাবা ছেলের কাছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হওয়ার জন্য ভর্ৎসনা শুনলাম আর তখনই ডেকে উঠল সালফার ক্রেস্টেড কক‍্যাটু। ওদের সমর্থন করলো না আমাকে সমবেদনা জানালো বুঝলাম না। ভারী সুদর্শন পাখি, খুবই বুদ্ধিমান নাকি। ওর সাথেই দেখলাম লাল টিয়া। দর্শনার্থীদের উপেক্ষা করে একদল হাঁস জলে নেমে সাঁতার কেটে দূরে চলে গেল। বেলে হাঁস (cotton teal), সাদা হাঁস, লাল ঠোঁট সাপের গায়ের মত চাকা চাকা দাগওয়ালা হাঁস (mallard?), রাজহাঁস সব মিলিয়ে ভীষণ সুন্দর ।  

আর দেখলাম ওয়ামবাট, বড় কালো ইঁদুর জাতীয় প্রাণী। খাঁচার গায়ে লেখা আছে, ওয়ামবাট বাইটস। ওয়ামবাট আর ক‍্যাঙ্গারু, দুটোই মার্সুপিয়াল অর্থাৎ পেটের থলিতে বাচ্চা বহন করে। মার্সুপিয়ালের বাংলা প্রতিশব্দটি বেশ। উপজঠরী। ডিম নয়, এরা সরাসরি বাচ্চা জন্ম দেয় কিন্তু সেই বাচ্চার বিকাশ তখনও অসম্পূর্ণ থাকে। যতদিন না তা সম্পূর্ণ হয়, মায়েরা বাচ্চাকে পেটের পকেটে রেখে "মানুষ" করে। অধিকাংশ মার্সুপিয়াল অস্ট্রেলিয়ায় বা তার আশেপাশে দেখা যায়, কেন কে জানে!

ওয়ারুক ছেড়ে চললাম কোয়ালা কনজারভেশন সেন্টারের দিকে। চিড়িয়াখানার মত বদ্ধ জায়গায় নয়, উন্মুক্ত, সহজ, নিজস্ব পরিবেশে ভ্রমণপিপাসু দের কোয়ালা দেখানোর জন্য এই সেন্টারটির পরিকল্পনা। অস্ট্রেলিয়ার আর একটি আশ্চর্য মার্সুপিয়াল হল এই কোয়ালা। দেখতে ছোটখাটো ভাল্লুকের মত বলে কেউ কেউ একে কোয়ালা বেয়ার ও বলেন। সত্যি বলতে কি কোয়ালার সফট টয়গুলো একদম টেডি বেয়ারের আদলে তৈরি।  কিন্তু বাস্তবে ভাল্লুক এর সঙ্গে কোয়ালার কোন সাদৃশ্য নেই। কোয়ালার খাদ্য হল ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা, তাও সব ইউক্যালিপটাস গাছ নাকি এদের পছন্দ নয়। খাবারের কমতি এরা পূরণ করে অতিরিক্ত ঘুম দিয়ে, আর ঘুমের জন্য এরা বেছে নেয় গাছের ডাল। কিভাবে যে গাছের ডাল থেকে পড়ে না গিয়ে সেখানে ঘুমিয়ে থাকে তা বোঝা ভার। জেগে থাকা কোয়ালা দেখা শুনলাম ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা খুব সামনে থেকে একটা ঘুমন্ত মা কোয়ালা দেখলাম, কোলে বাচ্চা নিয়ে। অনেক দূরে একটা কোয়ালা দেখলাম। সেটা জেগে আছে, বোঝা যাচ্ছিল কিন্তু নড়াচড়া আশ্চর্য রকমের শ্লথ।

এরপর রওনা হলাম ফিলিপ আইল্যান্ড নেচার পার্ক এর উদ্দেশ্যে। যেখানে বাস থামল সেখানে ঝোড়ো হাওয়ায় সব উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জোগাড়। চোখ জুড়ানো সমুদ্র আর সীগালের ঝাঁক। তবে সীগালের ডাক ভয়ঙ্কর কর্কশ। ওরা সংস্কৃত জানলে বলা যেত, তাবচ্চিৎ শোভতে, যাবৎ কিন্চিৎ ন ভাষ‍্যতে।

 এই দ্বীপটা ছোট্ট পেঙ্গুইন বা লিটল পেঙ্গুইন দের আবাসস্থল। সন্ধ্যে হলে এরা দলে দলে সমুদ্র থেকে ঘরে ফেরে, এদের ভাষায় পেঙ্গুইন প‍্যারেড। "পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে…... সব পাখি ঘরে ফেরে…"। পেঙ্গুইন যদিও পাখি, এদের ডানা নেই, তাই এরা উড়তে পারেনা। সেই জায়গায় ওদের আছে ফ্লিপার। হেলেদুলে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ওরা হাঁটে, ইংরেজিতে যাকে বলে, waddling. এদের মাথা পিঠ এবং পায়ের পাতার রং কালো কিন্তু পেটের রং সাদা। দেখলে মনে হয় সাদা শার্ট কালো প্যান্ট আর জুতো পড়া সাহেব।

সূর্য ওঠার আগেই এদের দিন শুরু হয়। নিজস্ব বাসা ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে ওরা চলে যায় সমুদ্রে। "বাস" প্রণালীর জলে প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি কিলোমিটার সাঁতার কেটে সংগ্রহ করে কড মাছ অথবা অ্যাংকোভি জাতীয় নানা ছোট ছোট মাছ।

অন্ধকার হওয়ার মুখে একটা একটা করে পেঙ্গুইন জড়ো হতে লাগল সমুদ্রের পাড়ে, তারপর বেশ কয়েকজন দল বেঁধে ওদের অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেঁটে ঘরে ফিরতে লাগলো। কেউ ফিরল একা, কেউ দুজনে কূজনে। ঠিক যেমনভাবে আমরা ছুটির পরে ছাত্রাবস্থায় বাড়ি ফিরতাম। শুধু ওদের জন্য সমুদ্র পাড়ে কোন ফুচকা ওয়ালা বা হজমিওয়ালা নেই।

ফেরার পথে শুরু হল বৃষ্টি। সাদা ময়ূর এর ভবিষ্যৎবাণী ব্যর্থ হবার নয়। জলে ভিজে শীতে কেঁপে কোনরকমে বাসের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছনো গেল। পেঙ্গুইনদের মতো আমাদেরও তো এবার ঘরে ফিরতে হবে।