ইছামতী


#

মানিকতলা মাছের বাজার অতি বর্ণময় স্থান। মাছওয়ালাদের হাঁকডাক এবং সমঝদার দের দরদাম, সব মিলিয়ে ভারী জমজমাট। এক সময় বাড়ির মাছের বাজারের দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়ে। তখন নিয়মিত যেতাম মানিকতলা বাজারে। সবচেয়ে চোখধাঁধানো ব্যক্তিত্ব ছিল, মা দুর্গার। ও নামটা আমার দেওয়া। কুচকুচে কালো, চুল চূড়া করে বাঁধা। মুখখানি অপরূপ লাবণ্যময়। উঁচু করে কাপড় পরা, পায়ে মোটা মল। অনায়াসে কেটে চলেছে বিশাল বিশাল মাছ, গড়িয়ে পড়া রক্ত লাগিয়ে দিচ্ছে অন্য মাছের গায়ে। ওর কালো হাতে রক্তের লাল রং আর সামনের বিশাল আঁশবঁটি, মনে হত, ও যেন বাজারে নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে বসে আছে। ওর পাশে বসে থাকতো একটি অতি সংযমী বিড়াল, 'হাতে করে না দিলে কিছুই মুখে দেবে না', রণপ্রিয়ার মুখে মমতা।

আর ছিল নীরব শিল্পী, যার নাম আমি দিয়েছিলাম গোমড়া থোরিয়াম। কোন কথা বলে না, শুধু অবাক দক্ষতায় ভেটকি মাছ ফিলে করে চলে। পাশে থাকে আর এক সাগরেদ। সে খদ্দেরদের সঙ্গে দরদাম করে, কথা বলে, বিক্রি করে। আমি অবাক হয়ে গোমড়ার হাতের কাজ দেখতাম। যে কোনো সার্জেনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর যোগ্য।

 আর ছিল পাবদা বিলাস। বলাবাহুল্য, এই নামটাও আমার দেওয়া। ভাসা ভাসা চোখ, দেখলেই বলতো, 'পাবদা নেবে না? বড়ি, ধনেপাতা দিয়ে ঝোল করবে, যেন অমৃত ।' ওকে জিজ্ঞেস করলাম একদিন, 'মাছ টাটকা তো?' 'কি যে বল, ইছামতীর মাছ!'  'তাই? তুমি ইছামতীতে মাছ ধরতে যাও ?' 'আমি না, ভাই যায়, আমি সেই মাছ বিক্রি করতে নিয়ে আসি'। আমি কল্পনায় দেখতে পাই গঙ্গা উপন্যাসের তেঁতুলে বিলাস, সকালে মাছমারাদের নৌকা যাচ্ছে নদীতে, সারাদিন মাছ ধরে সন্ধ্যায় ফিরে আসছে ঘাটে, সেখানে অপেক্ষা করে আছে মাছের আড়তদার, ফড়ের দল। আমি মাছওয়ালার নাম দিই, পাবদা বিলাস। জিজ্ঞেস করি, তোমার বাড়ি কি ইছামতীর ধারে? কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না মাছওয়ালা, অন্য খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলে। আমি পাবদা কিনি, দরকার না থাকলেও কিনি, না কিনে থাকতেই পারিনা। বাড়িতে বলে, 'একদম ঠকিয়ে দিয়েছে, এত দাম দিয়ে এই মাছ!' কি করে বোঝাই, ভরা মাছের বাজারে, যে আমায় অনায়াসে নিয়ে যেতে পারে ইছামতীর পাড়ে, সে কি সোজা লোক! খুব ইচ্ছা ছিল ওকে একদিন বাড়িতে ডেকে এনে বড়ি, ধনেপাতা দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল খাওয়াব, কিন্তু এ বাড়িতে তা সম্ভব নয়। এরা আমায় এমনিতেই বোকা ভাবে, এরপর ঠিক পাগল ভাববে। ইছামতীর ধারে আমার যদি একটা নিজস্ব বাড়ি থাকতো!

 

ইছামতী