আরণ্যক এক্সপ্রেসে মেদিনীপুর থেকে ফিরছি। সবে খড়গপুর ছাড়িয়েছি, বুবকার ফোন, "আজ ফিরছো তো?"
"হ্যাঁ, ট্রেনে আছি।"
"কাল স্কুলে একটা প্রজেক্ট জমা দিতে হবে।"
"সে কি ?"
"হ্যাঁ, ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে আর্ট অবজেক্ট"। "কি মুশকিল, তুই যা পারিস কর, আমি কি করবো।"
" আমি কিছু পারবো না, বলে খপাৎ করে লাইন কেটে দিল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা কাটিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করি। দিব্যানের মাকে ফোন লাগাই। দিব্যান ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ওর মা খুবই মিশুকে। একটু পুত্রগর্বে গরবিনী, তবে অমন পুত্র থাকলে গর্ব একটু হবে নাই বা কেন। আমার ফোন পেয়ে বললেন, "সে কি, আপনি জানতেন না? এ তো এক সপ্তাহ আগে বলেছে।"
"কিছু একটা আইডিয়া দিন না।"
" আরে, আমরা তো মিস্টার গোমস্ কে দিয়ে করাই। সিডি দিয়ে যা একটা ল্যাম্পশেড বানিয়ে দিয়েছেন, ভাবা যায় না।মিসেস ঘোষ ও অনেককে বানিয়ে দিয়েছেন, পুরনো মোজায় তুলো ভরে অ্যানিমেল ফিগার, পুতুল। আচ্ছা দাঁড়ান, ওদের ফোন নাম্বার পাঠিয়ে দিচ্ছি।দেখুন, যদি কিছু পেয়ে যান।" অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিই, কিন্তু মনটা খচখচ করতে থাকে। পয়সা দিয়ে প্রজেক্ট কিনে দেবো? এটা তো ওদের নিজের হাতে করার কথা। আমার করে দেওয়াটাও অন্যায়। কিন্তু তাতে ওর তো কিছু ইনভলভমেন্ট থাকবে। নাঃ, যা থাকে কপালে নিজেরাই করব। তথাগতর মাকে ফোন লাগাই। তথাগত বুবকার মত মাঝারি মানের ছাত্র, একটু দুষ্টু আর ওর মা নিপাট ভালো মানুষ। "আর বলবেন না দিদি, করেছি একটা, ছেলের পছন্দ হয়নি। বাড়িতে ননদ ননদাই এসেছেন আসানসোল থেকে। স্কুলে যেতে পারছিনা। আমরা কি প্রফেশনালদের মত পারি!" "কি বানালেন আপনি? একটু আইডিয়া দিন না।" "দেশলাই বাক্স, সিগারেট বাক্স দিয়ে ডলস্ হাউস বানালাম, ফিনিশিং ভালো হয়নি, ছেলে বলছে, আমি মেয়ে নাকি এসব নিয়ে যাব না। কি যে করি!"
" আমাকে একটু আইডিয়া দিন না, সোজা কিছু, সময় নেই, বুঝতেই পারছেন।"
" বাদাম দিয়ে পাখি বানাবেন?"
" সেটা কিরকম ?"
" বাদামের খোলা গুলো দিয়ে পাখির গা হবে, স্কেচ পেন দিয়ে ঠোঁট, পা এঁকে দেবেন, শুকনো ডালপালা ফেভিকল দিয়ে আটকে গাছ বানাবেন, কেমন হবে জানিনা। তথাগতর জন্য অল্টারনেটিভ ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু সময় পেলাম না।"
আমি চমৎকৃত। এটাই করব। বাদামওয়ালা ট্রেনে পেয়ে যাব। কুড়ি টাকার বাদাম কিনলে অনেক খোলা জমবে।আর ডালপালা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। বুবকাকে ফোন লাগাই। "দাদুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দোকানে যাও, থার্মোকলের সীট কিনে আনো। আর ইরেজার, স্কেচ পেন, তুলি, রং সব এক জায়গায় করো। যা নেই, দোকান থেকে নিয়ে এসো।" বাজার হাটে ছেলের মহা উৎসাহ। তাই ওসব নিয়ে চিন্তা নেই । এর মধ্যে বাদাম ওয়ালা পাকড়ে বাদাম কেনা হলো। কিন্তু ড্যামেজ না করে বাদামের খোলা ভাঙ্গা বেশ কঠিন কাজ। বাদামের গায়ে কি জলরং বসবে! কি জানি! পৌঁছাই আগে। ট্রেন প্রচুর লেট। সাঁতরাগাছি থেকে ট্যাক্সি নিলাম, তাড়াতাড়ি পৌঁছাব বলে। গিরিশ পার্কের কাছাকাছি এসে গাড়ি গেল বিগড়ে। সাড়ে আটটা বেজে গেছে, কখন প্রজেক্ট হবে! শর্মার দোকান থেকে একটু লস্যি খেয়ে এনার্জি সংগ্রহ করতে হাঁটা লাগালাম। রাস্তা পার হতেই যা দেখলাম, মাথায় নতুন আইডিয়া খেলে গেল। রকমারি রঙিন কাচের চুড়ির দোকান। কিনে ফেলি।পাশেই একটা শাড়ির ডিজাইন করার দোকান থেকে ময়ূরের ছবি সংগ্রহ করি, তারপর নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরি। ছেলে নির্বিকার, সময়মতো প্রজেক্ট জমা না দিলে কি আর হবে! বকুনি খাওয়া, নম্বর কম পাওয়া এসব তুচ্ছ ব্যাপারে ওর কিছু যায় আসে না। আমি ওকে অর্ধেক চুড়ি দিয়ে বললাম, "একটা খবরের কাগজ পেতে হাতুড়ি দিয়ে ভাঙ, আমি চান করে আসি।" এমন অভিনব কাজ পেয়ে সে তো মহা খুশি। এরপর থার্মোকলে ময়ূরের ছবি আটকানো হল, তারপর ভাঙা চুড়ির টুকরো ফেভিকল দিয়ে বসিয়ে তৈরি হলো রঙিন ময়ূর। সেকি তার রূপ। কাঁচের মধ্যে দিয়ে আলোর প্রতিফলনে যেন ঝিলিক মারছে। কয়েকটা কাচের চুড়ি শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল, যদিও তা পরা হয়ে ওঠেনি।
ভাঙাচোরা হরেক সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে যারা সংসার সাজিয়ে তুলতে পারে, এইসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা তাদের কাছে একদম বাঁয়ে হাত কী খেল!
Khub bhalo
Darun laglo pore... nijer ar meye r galpo jeno.. Aranyak express ar taxi tao mile gelo!!!
Ananya
20-06-2020 09:14:34