কথা হচ্ছিলো রবীন্দ্রনাথের “বর্ষার দিনে” গান টি নিয়ে। এটিকে কবি গীতবিতানে বর্ষা পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করলেও এটি একটি অনবদ্য প্রেমের কবিতা, তাই এটিকে প্রেম পর্যায়ে রাখা উচিত, বন্ধুর অভিমত। আমিও সহমত, তবে একটু ভিন্ন ভাবে। আমি মনে করি যেহেতু এখানে “তারে” বলতে কবি কাকে বুঝিয়েছেন, অথবা তাকে কি বলার কথা বলা হয়েছে, সে কথা কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই, অতএব পুরোটা তেই পাঠকের কল্পনার অবকাশ রয়ে গেছে। বিভিন্ন বয়সে মানুষ বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে।কবি যার মনের ভাবনা ব্যক্ত করেছেন, তার বয়স কত, সে কথা কোথাও বলেন নি। ফলে গোটা কবিতায় আমি কিভাবে আমার বিভিন্ন বয়সের ছবি দেখতে পাই, সেই কথাই বলি।
“এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়! /এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে/ তপনহীন ঘন তমসায়” ।
যখন স্কুলে পড়তাম, বৃষ্টি হলেই ঠাকুরকে বলতাম, আজ যেন রেইনি ডে বলে ছুটি হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে বলি, পড়তাম বিডন স্ট্রিট এ হোলি চাইল্ড স্কুলে। সামান্য বৃষ্টিতেই স্কুলের রাস্তা জল থৈ থৈ। যাতায়াতের ভীষণ অসুবিধা, জুতো মোজা তো বটেই, জামাও ভিজে যেত। কিন্তু স্কুল সহজে ছুটি দিতো না।আমরা যারা কাছাকাছি থাকতাম, স্কুলে যেতাম রেগুলার অ্যাটেনডেন্স এর প্রাইজের লোভে। কিন্তু বৃষ্টির দিনে সবাই বাড়িতে থাকার আনন্দ ছেড়ে স্কুলে যাওয়ার কোনো মানে নেই, তাই এই প্রার্থনা। বেথুনে অবশ্য কোনো চাপ ছিল না,ইচ্ছেমতো যেতাম। আবার চাপে পড়লাম আর জি কর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে। ভগবান কে বলে লাভ নেই, এখানে রেইনি ডে বলে কিছু নেই। অথচ জল জমার অবস্থা বিডন স্ট্রিট এর চেয়েও খারাপ। একমাত্র ভরসা যদি টিচার না আসেন।
এরপরের গন্তব্য ওয়ার্ধা। সে এক অদ্ভুত জায়গা। বৃষ্টি হয় না, হলেও এত কম, মাটি ভেজে না, জল মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায়। সেখানে সর্বক্ষণের প্রার্থনা, বৃষ্টি হোক, আমরা ভিজি। একবার বৃষ্টি এসেছে, আমরা সব রিসার্চ স্কলাররা মহানন্দে ভিজছি, তাই দেখে হেড হরিনাথ স্যার বললেন, “useless fellows”।
এরপর নিজের পড়াশুনার পাট চুকলেও শুরু হলো ছেলের পড়াশুনা আর আমার পড়ানোর পালা, প্রায় একসঙ্গে, ফলে চাহিদা দুই রকম।ছেলের জন্য চাহিদা, স্কুল যেন বন্ধ থাকে, নিজের জন্য চাহিদা, ছাত্ররা যেন না আসে! ভগবান বেচারার জন্য সত্যি কষ্ট হতো। এত লোকের এত চাহিদা, তার ওপর একই লোকের বিভিন্ন চাহিদা ব্যালান্স করে চলা কি চাট্টিখানি কথা!
পড়াশুনার ব্যাপারে এত চাহিদা হলেও, খাওয়ার ব্যাপারে আমি ভারী ভদ্র লোক, এক কথার মানুষ। বর্ষা মানেই খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, পাঁপড়।সঙ্গে ডিম্ নয়তো মাছ ভাজা। মা কিংবা শাশুড়ি মা তো বটেই, গৃহ সহায়িকা, এমনকি সুইগি/জোমাটো র ডেলিভারি বয় রা পর্যন্ত এই খবর জানে। যেখানে কাজ করেছি, সেখানকার ক্যান্টিন চালকরা ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, ডিপার্টমেন্ট এ খিচুড়ি খাওয়া হবে কি না, ওরা সেইমতো তৈরী করবে। কখনো আমি ফোন করে অর্ডার দিয়েছি, আজ কিন্তু খিচুড়ি খাবো।
“সে কথা শুনিবে না কেহ আর, / নিভৃত নির্জন চারি ধার।/ দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী, /আকাশে জল ঝরে অনিবার।/ জগতে কেহ যেন নাহি আর”
এই বিষয়ে দুটি স্মৃতি, দুটোই মা কে নিয়ে, প্রথম টা ১৯৭৮ সালের কথা, পুজোর আগে কলকাতা বানভাসি, কোনো ধারণাই ছিল না আমাদের বন্যা সম্পর্কে। রচনা বই এ পড়েছি শুধু। বৃষ্টিতে জল জমা আর বন্যা যে আলাদা, সেটা সেবছর প্রথম অনুভব করলাম। রাস্তায় না কি নৌকা চলছে, তাতে করে বিক্রি হচ্ছে চাল, ডাল, আলু, ডিম্।কাকু রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, কখন কিসের নৌকা আসবে, পাড়ার ছেলেরা ও বাড়ি বাড়ি খবর দিতো।সবাই চিন্তিত, রেডিও তে খবর চলছে, পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে। এমন এক সময় বৃষ্টি কমল, আমরা ভাবছি সব ঠিক হতে চলেছে, সেই সময় মা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। আমরা দুই বোন বসে আছি "মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি"।সবার অসুখে মা কে সেবা করতেই দেখেছি, মা কে অত অসুস্থ কখনো দেখি নি। বাবা কাকা আলোচনা করছে, কোনো ডাক্তার পাওয়া তখন অসম্ভব, কোথায় কিভাবে নিয়ে যাওয়া যায়! এর মধ্যে নিজে নিজেই মায়ের জ্ঞান ফিরলো। কোথাও নেবার দরকার পড়লো না। মায়ের মতে কি ভাবে চার বেলা খাওয়া দাওয়া চলবে, এই দুর্ভাবনা থেকে মায়ের অসুস্থতা।আজ মনে হয়, নিজে না খেয়ে বা কম খেয়ে হয়তো চাল ডালের সাশ্রয় করছিলো।এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি, আমি পরের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই। আমাদের একটা সম্ভাব্য রচনা ছিল কলকাতার বন্যা। সেই রচনাটা মা লিখে দিয়েছিলো। আমি বলেছিলাম তোমার অজ্ঞান হবার কথাটা লিখলে না কেন, মা বলেছিলো এমন কিছুই না কি হয় নি, ওসব আমাদের মনের ভুল।
পরের স্মৃতি অবশ্য বন্যার নয়, বৃষ্টির। ১৯৮১ সালে যেবার আমি ডাক্তারি তে চান্স পেলাম, সেই বছর। সেদিন আমার মেডিকেল কলেজে যাবার কথা, একটা ফর্ম জমা দেবার জন্য। সকাল থেকে বৃষ্টি, ক্রমশ জল জমে গেলো। বাস চলছে না, মা আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বললো, মা জমা করে দিয়ে আসবে। তারপর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, লোড শেডিং (তখন টানা বৃষ্টি হলে কারেন্ট চলে যেত), ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে, রাস্তা দিয়ে কোনো যান বাহন চলছে না, আমরা দুই বোন বসে আছি মায়ের প্রতীক্ষায়। মোবাইল ছিল না, ল্যান্ড ফোন খারাপ, থেকেও কি বা হতো! কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ় শব্দটাকে যেন অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি করেছিলাম সেই দিন।
“সমাজ সংসার মিছে সব, /মিছে এ জীবনের কলরব।/কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে/ হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব” ।
এই কথা গুলো আমার আর আমার ছেলের গল্প। রোজ আমি ছেলেকে স্কুল থেকে নিতে যাই না স্বাভাবিক ভাবেই, আমার সেই সময়ই নেই। তবে দরকার পড়লে তো যেতেই হয়। এক বৃষ্টির দিনে গাড়ি বিগড়েছে, ড্রাইভার বললো বুবকা কে নিয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে অপেক্ষা করতে। ছুটি র সময় আমাকে দেখে ছেলের মহা ফুর্তি, বকবক করতে করতে হাঁটছে, হঠাৎ একটা নিচু মতো জায়গা, জল দাঁড়িয়ে আছে, ছেলে তাকালো আমার দিকে, দুস্টুমি ভরা চোখ দেখেই বুঝেছি কি করতে চায়। আমি বলতে গেছি, একদম না, বুবকা, তার আগেই জোড়া পায়ে জলে লাফ। জানি এটা ওদের বন্ধুদের প্রিয় খেলা, "স্প্ল্যাশ স্প্ল্যাশ"। এতে যে জুতো মোজা ভিজে গেলো, বর্ষায় মোটেও শুকোবে না, এসব বলে লাভ নেই। মেজাজ বিগড়োলে কি কান্ড করবে, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে আমার প্রেস্টিজ পাংচার। তার চেয়ে আনন্দে থাকুক, ফুর্তিতে থাকুক। বৃষ্টি হলে ময়ূর যখন খুশি তে নাচে, আমরাও তো সেই খুশির সামিলই হই। ঠিক কি না?
“তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার/ নামাতে পারি যদি মনোভার? / শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে/ দু কথা বলি যদি কাছে তার/ তাহাতে আসে যাবে কিবা কার”?
এবারের স্মৃতি মুর্শিদাবাদের গ্রামে। প্রথম PSC পোস্টিং। চারপাশে ধু ধু মাঠ, ডাক্তারের কোয়ার্টারটাই যা পাকা ঘর, আসে পাশে বাকি সব কুঁড়ে ঘর। উল্টোদিকের বাড়িতে একটি নিটোল গৃহস্থালি, হাসি খুশি বৌটি সকাল থেকে নানা ধরণের কাজ করে। ঘর ঝাঁট দেওয়া, কুটনো কুটে, বাটনা বেটে রান্না বান্না, ছাগল মুরগির দেখ ভাল করা, বাসন মাজা, কাজের বহর দেখে আমি হাঁপিয়ে যেতাম। এক বৃষ্টির দিনে হঠাৎ শুনি দরজায় ধাক্কা, বৌটি ডাক দেয়, দিদি, শিগগির এসো, তোমার জন্য কি এনেছি দ্যাখো। কাপড়ের আড়াল থেকে বের করে এক জ্যান্ত কৈ মাছ। বর্ষার জলে ডাঙায় উঠে এসেছে গো, তোমার জন্য নিয়ে এলাম।
এ মা, তুমি ধরেছো, তুমি খাও, আমি বলি।
এটুকু মাছ আমি কাকে দেব গো? তোমার জন্যই ধরলাম। তুমি খাও না?
মুখটা কি একটু মলিন দেখালো। গৃহকোণে সত্যি কথাই বলে দিলাম, “জ্যান্ত মাছ মেরে,কেটে আমি তো রাঁধতে পারবো না”। শুনে তো সে হেসে কুটিকুটি,
-ও দিদি, এত মানুষ কাটো আর সামান্য মাছ কাটতে পারবে না!
-এমন ভাবে বলছো যেন আমি জল্লাদ। কাটি তো অজ্ঞান মানুষ, তাও তার একটা বিশেষ অংশ।
তবু তার হাসি থামে না। বললো একটা হাঁড়ি দাও। মাছটাকে জল দিয়ে রেখে বলে গেলো, পরে এসে সব করে দিয়ে যাবে। তা সে সব করলোও। কেটে কুটে রান্না অবধি। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘর গেরস্থালি নিয়ে দু কথা কেন, দু কুড়ি কথা দুজনে দুজনের কাছে বলে ফেললাম। তারপর আমি বললাম,
-এতই যখন করলে, দুটি খেয়ে যাও আমার সঙ্গে।
-না দিদি, উনি আসবেন, তারপর।
বাইরে তখনো অথৈ শ্রাবন।
“ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়, /বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।/যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে/ সে কথা আজি যেন বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়”
সে ছিল কিশোরীবেলা, লোকের কথায় তখন যেতো আসতো।অখণ্ড বিশ্বে আমাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য দু তিন জন বৈ কেউ নেই, এই সহজ সত্য টা বুঝতাম না, মনে হতো সবাই যেন আমার দুর্বল মুহূর্তের সাক্ষী, তাই নিয়ে বিদ্রুপ করছে।
এমন এক সময়, পূজায় পড়েছি নতুন জুতো, তাতে হাই হিল, নিউ মার্কেট থেকে কেনা। তখন সেই ছিল আমাদের ফ্যাশনের মাপকাঠি। পুজোয় সেজে গুজে বেরিয়েছি, শুরু হলো বৃষ্টি, দেখতে দেখতে রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত হলো,বাড়ি ফেরার। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমার একটা পা ছোট, একটা পা বড়ো। কি হলো! খানা খন্দে পড়লাম না কি।তারপর দেখি, একটা পায়ের জুতো থেকে হিল গেছে খুলে। কবির হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে, আমার হিল ভেসে যায় বৃষ্টিজমা জলে। ইচ্ছা হচ্ছিলো দুটো জুতো টান মেরে খুলে ফেলতে, কিন্তু জলের মধ্যে জমে থাকা নোংরার বহর দেখে সে ইচ্ছা দমন করলাম। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরলাম। ফ্যাশন যে সবার জন্য নয়, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতে পারি নি।
এই সব জলছবি আঁকা থাকে বলেই তো শ্রাবণের মেঘে মেঘে বেজে ওঠে মেঘমল্লার।
এমন দিনে তারে বলা যায়
দারুণ লিখেছিস। আমি সত্যিই তোর লেখার প্রেমে পড়ে গেছি।
Santa Saha
28-07-2025 23:19:26