অচেনাকেই চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে


#

সংকটের কল্পনাতে

কোভিড ১৯ সংক্রমণ মানুষের শরীরের কি কি ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম এবং এই ক্ষতির পরিমাণ ক্ষণস্থায়ী না দীর্ঘস্থায়ী সে নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু এই সংক্রমণ যে সর্বস্তরের মানুষের মনের উপর বড় রকমের চাপ সৃষ্টি করেছে, সে কথা অনস্বীকার্য। এমনিতেই সারা পৃথিবী জুড়ে মানসিক সমস্যা ক্রমবর্ধমান। ২০০১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) পক্ষ থেকে যতই বলা হোক না কেন, "stop exclusion, dare to care", পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন মানসিক সমস্যার মধ্যে যেটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তা হলো অবসাদ বা depression। এই সত্য আজ প্রমাণিত যে প্রতিকূল পরিস্থিতির সংকটের (stress) জন্যই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে অবসন্নতার পারদ। অথচ প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই তো গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। গবেষণা বলছে প্রতিকূল অবস্থা যখনই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়, তখনই তৈরি হয় সংকট। অনিশ্চয়তা (uncertainty) কিভাবে মানুষের মনের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে, সেই তথ্য পরিবেশনই এই প্রতিবেদনের উপজীব্য।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় পরে আসছি, আগে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। পরীক্ষা পূর্ববর্তী উদ্বেগের সঙ্গে আমরা সকলেই অল্পবিস্তর পরিচিত। কোন সন্দেহ নেই, পরীক্ষা ছাত্রছাত্রী কাছে একটি সংকটজনক (stressful) ঘটনা। একাধিক বিষয়ের বিপুল পাঠ্যক্রম আয়ত্ত করে অচেনা কোন জায়গায় গিয়ে অচেনা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পরীক্ষা দিতে হয় ।

মজার ব্যাপার হলো, সংকটের মূল কারণটি কিন্তু প্রশ্ন অজানা থাকার বিষয়টি। তার কারণ, এই অংশটিই সবচেয়ে অনিশ্চিত। তাই প্রশ্নপত্র হাতে পেলে এবং মোটামুটি পরিচিত অংশ থেকে প্রশ্ন এলে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই এই সংকট কাটিয়ে ওঠে, আর তা না হলে সংকট বেড়ে যায়। পরীক্ষার ফল মনোমত না হওয়ার ঘটনা ছাত্রছাত্রীকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। তাই সব পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা কিন্তু সমান সংকট তৈরি করে না। বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়া অন্যান্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে বা  উচ্চশিক্ষার সেমিস্টার প্রথায় অকৃতকার্যতার স্থায়ী প্রভাব পরবর্তী সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত থাকে। এইসব ক্ষেত্রে সংকট কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা অন্যান্য বোর্ডের পরীক্ষার তুলনায় কম।

অনিশ্চয়তার কাছে বারবার হেরে যাই আমি

আসা যাক মূল বিষয়ে। যে কোনো সংকট মোকাবিলা করার জন্য মানুষের হাতে আছে দুটি অস্ত্র, যার নিয়ন্ত্রক হলো মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা হাইপোথেলামাস (hypothalamus) । সংকটের প্রাথমিক পর্যায়ে (acute) এটি উদ্দীপ্ত করে এড্রিনাল গ্রন্থির মেডালা অংশটিকে। নিঃসৃত হয় একটি হরমোন, নর-এপিনেফ্রিন। এটি নিজে বা এপিনেফ্রিনে পরিবর্তিত হয়ে মানুষকে লড়াই করার শক্তি দেয়। আবার নিয়ন্ত্রক যখন বোঝে লড়াই করা অর্থহীন, তখন সে ‘য পলায়তি স জীবতি’, এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে মানুষকে পলায়নে উদ্বুদ্ধ করে। হরমোনটিকে তাই flight or fight hormone ও বলা হয়।

কিন্তু সংকট যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে হাইপোথেলামাস উদ্দীপ্ত করে পিটুইটারি গ্রন্থি। এই গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোন, ACTH (পুরো নাম Adrenocorticotrophic hormone) অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কর্টেক্স অংশ থেকে নিঃসরণ করে কটিসল হরমোন।

অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির এই দুটি অংশ থেকে নিঃসৃত হরমোন দুটি সংকট মোকাবিলায় প্রধান হাতিয়ার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত। কিন্তু এই তথ্যের প্রেক্ষাপট শারীরবৃত্তীয় (physiological)। মানসিক সমস্যা বিশেষত অনিশ্চয়তার সঙ্গে সংকটকালীন পরিবর্তনের যোগসুত্রটির আবিষ্কার সাম্প্রতিক।

যে কোনো ধরনের সমস্যা, যার সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক জ্ঞান কম এবং যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা একটি সমস্যা হিসেবে মস্তিষ্কে গৃহীত হয়। কোভিড ১৯এর মহামারী ঠিক এই কারণেই ভয়াবহ মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মানুষ তার স্বাভাবিক প্রকৃতি অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব এই রোগের কারণ অনুসন্ধান করে একে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে চলেছে। দেখা যাক এই পরিস্থিতিতে আমাদের মস্তিষ্কে কি ঘটে চলেছে। আমাদের মস্তিষ্ক বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত যাবতীয় খবর সংগ্রহ করে তাকে বিশ্লেষণ করে চলেছে এবং কি করা উচিত সেটি নির্ধারণ করার চেষ্টা করে চলেছে। যদি তার এমন কোন পদ্ধতি জানা থাকে, যার দ্বারা সে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম তবে সে সেই পদ্ধতি গ্রহণ করবে।  এই কারণে আমরা মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহারে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। কিন্তু যখন তার আর কোন পদ্ধতি জানা থাকে না, তখন সে তার অপারগতার খবর পাঠিয়ে দেয় মস্তিষ্কের ভিন্ন একটি অংশে। এই অংশটি তখন শারীরবৃত্তীয় নিয়মে নর-এপিনেফ্রিনকটিসল ইত্যাদি হরমোন নিঃসর ণের মাধ্যমে সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়। এই বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য মস্তিষ্কে প্রচুর শক্তি প্রয়োজন হয়, যা পূর্বোক্ত দুটি হরমোনের সাহায্যে সে আহরণ করে। এই ঘটনাটির নাম দেওয়া হয়েছে 'মস্তিষ্কের স্বার্থপরতা' (selfish brain theory)।

দিন যায় রে বিষাদে মিছে দিন যায়

এবার দেখা যাক মানসিক সংকট কিভাবে অবসাদের জন্ম দেয়। অনিশ্চয়তা যখন শারীরবৃত্তীয় নিয়মে হাইপোথ্যালামাস কে উদ্দীপ্ত করে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ACTH নিঃসরণ করে তখন তার সঙ্গে আরেকটি হরমোন নিঃসৃত হয়, যার নাম প্রোল্যাকটিন। প্রোল্যাকটিন এবং কটিসল দুটি রাসায়নিক যৌগের তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াকে অথবা কার্যকারিতাকে বন্ধ করে দেয়। এই দুটি যৌগ হল যথাক্রমে ডোপামিন এবং সেরোটোনিন, মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই দুই যৌগের কাজের বিঘ্ন ঘটার সূত্র ধরেই অবসাদের জন্ম। 

এছাড়া অবশ্য আরো কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার পরিবর্তন মস্তিষ্কের কোষগুলিতে পরিলক্ষিত হয়, অবসাদের সঙ্গে যাদের যোগসুত্র পাওয়া গেছে। তবে উপরোক্ত তত্ত্বটি এখন পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য এবং স্বীকৃত। অবসাদের জন্য যে সব ওষুধ দেওয়া হয়, সেগুলো মূলত সেরোটোনিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করেই কাজ করে। আর্থসামাজিক জটিলতার ক্রমাগত বৃদ্ধির পরিপেক্ষিতে কোভিড মহামারীর আগেও যত রকমের মানসিক সমস্যা বিশ্বজুড়ে চিহ্নিত হয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল অবসাদের সমস্যা। এই সমস্যা এতটাই বেড়ে যাচ্ছিল যে ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্লোগান দিয়েছিল, "Depression, let's talk" এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কোভিড ১৯ এর মহামারী। আকস্মিকভাবে সারা পৃথিবী জুড়ে বেড়ে গিয়েছে মানসিক অবসাদ।

সত্যরে লও সহজে

তাহলে অবসাদই কি আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি? এর থেকে মুক্তির কি কোন উপায় নেই? আশার কথা শোনাচ্ছেন বৈজ্ঞানিকরা। যত দ্রুত আমরা মেনে নিতে পারব যে, কিছু সংকট জীবনে থাকবে এবং সবকিছু কখনোই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না ততো তাড়াতাড়ি মস্তিষ্ক সংকটকে অনিশ্চয়তা হিসেবে চিহ্নিত করা বন্ধ করে দেবে। এই মেনে নেওয়া মস্তিষ্কের কাছে মাস্ক ব্যবহার বা স্যানিটাইজার ব্যবহারের মতো একটি আবশ্যিক পদ্ধতি। তাই সংকট মোকাবিলায় যা যা করা প্রয়োজন, যে যে নিয়ম মেনে চলা প্রয়োজন, তা অবশ্য করণীয় ও পালনীয়। কিন্তু যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সংকটের সেই অংশ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাই ভালো। বরং যেসব কাজ আমাদের আনন্দ দেয়, মস্তিষ্ককে সেইসব সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োগ করতে হবে। গান শোনা, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, ব্যায়াম, ধ্যান (meditation), যার যেমন ভালো লাগে, তাকে সেই সব কাজে বেশি সময় দিতে হবে। যারা ঈশ্বর বিশ্বাসী, তারা অনিশ্চয়তা দূরীকরণের দায়ভার ঈশ্বরে সমর্পণ করে, প্রার্থনার মাধ্যমে মানসিক শান্তি অর্জন করতে পারেন।

একথা সকলকেই মেনে নিতে হবে, 'এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা, সত্য, তবু শেষ সত্য নয়’। পৃথিবীকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা করে তুলতে সমগ্র মানবজাতির আনন্দে থাকা যে বড় প্রয়োজন।

উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন

  1. T.E. Behrens, M.W. Woolrich, M.E. Walton, M.F. Rushworth. Learning the value of information in an uncertain world. Nat. Neurosci., 10 (2007), pp. 1214-1221
  2. A.O. de Berker, R.B. Rutledge, C. Mathys, L. Marshall, G.F. Cross, R.J. Dolan, S. Bestmann. Computations of uncertainty mediate acute stress responses in humans. Nat. Commun., 7 (2016), p. 10996
  3. Lazarus R. S. From psychological stress to the emotions: A history of changing outlooks.  Annual Review of Psychology 1993; 44 (1): 1–21.